‘নদীর এ-পার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ও-পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।’ কোন পার ভাল আছে কাশ্মীরের? ভারতভুক্ত কাশ্মীর, না কি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর?
গত এপ্রিল এবং মে মাসে একাধিকবার পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। দাবি তাঁদের অতি সাধারণ, জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে, বিশেষত গম এবং বিদ্যুতের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু এই নিতান্ত গণতান্ত্রিক দাবিও মানতে নারাজ সেখানকার সরকার। আন্দোলনের ওপর পুলিশের অত্যাচারে ইতিমধ্যেই অন্তত চারজনের মৃত্যু ঘটেছে। আহত এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যা বহু। পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার করেও তা দমন করতে পারেনি। অবশেষে আন্দোলনের চাপে পাক অধিকৃত কা¬শ্মীরের সরকার বিদ্যুতের দামে কিছু ছাড়ের ঘোষণাও করেছে।
এর পরেও ক্ষোভে ফুঁসছেন এই অংশের মানুষ। গত বছর আগস্টেও একই রকম আন্দোলন সেখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। অসংখ্য বঞ্চনা, শোষণ, জুলুমের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে তাঁদের দিন কাটে। স্বশাসনের অধিকার, সাংস্কৃতিক-সামাজিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, খেয়ে-পরে সুষ্ঠুভাবে বাঁচার মতো রোজগারের অধিকার সবই তাঁদের কাছে অধরা। কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার কিংবা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রাদেশিক সরকার– কোনও বুর্জোয়া সরকারই সাধারণ মানুষের অধিকারের তোয়াক্কা করে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রদ করা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি র দাবির সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষের অন্যান্য অধিকারের প্রশ্নগুলি।
এ দিকে ভারতভুক্ত কাশ্মীরে কেমন আছে জনগণ? ১৯৯০-এর দশকে গোটা জম্মু-কাশ্মীর জুড়ে যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল ঘটনাচক্রে তারও দাবি ছিল বিদ্যুতের দাম কমানো, লোডশেডিং বন্ধ, দ্রব্যমূল্য হ্রাস, আপেল সহ সমস্ত বাগিচা ফসলের যথাযথ দামের ব্যবস্থা, বেকারদের জন্য কাজ, সমস্ত পরিবারগুলির রোজগারের বন্দোবস্ত ইত্যাদি। সেদিন জম্মু-কাশ্মীর ও কেন্দ্রের সরকার জনগণের দাবি শোনার বদলে সামরিক বাহিনীর অস্তে্রর জোরেই আন্দোলন দমন করে দেবে ভেবেছিল। তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। জনগণের প্রতি সরকারের চরম নিপীড়নমূলক মনোভাবের সুযোগে শক্তি সঞ্চয় করেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি। পুরো উপত্যকা জুড়ে তীব্র জনরোষ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ছেড়ে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির হাতে শক্তি জুগিয়েছিল। বলা বাহুল্য, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল জনগণের দাবির প্রতি চরম উপেক্ষার কারণেই।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তির সময় সংবিধানের ৩৭০ ধারার মধ্য দিয়ে সে রাজ্যের মানুষের কিছু বিশেষ অধিকার সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত সরকার। আজ সে অধিকার লোপ করে দিয়েছে মোদি সরকার। কাশ্মীর এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন, দীর্ঘকাল কোনও নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভাও নেই। সে রাজ্য আজ ভুগছে চরম বেকারত্বের জ্বালায়। নেই ফসল বাজারজাত করার পরিকাঠামো, ফসলের ন্যায্য দাম। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে অথচ দীর্ঘ সময় লোডশেডিং প্রতিদিনের ঘটনা। এই সমস্যাগুলির কোনওটির দিকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ নজর নেই। কাশ্মীরের মানুষের মত প্রকাশের অধিকার চরমভাবে পদদলিত, প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকরা পর্যন্ত সরকারের সামান্য সমালোচনা করলেই জেল, নির্যাতনের সামনে পড়ছেন। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কাকে বলে তা বহুকাল হল কাশ্মীরের মানুষ যেন ভুলেই গেছেন। রাস্তায় বেরোলেই তল্লাশির সামনে তাঁদের পড়তেই হবে। এত নিরাপত্তা বাহিনী থেকেও সাধারণ মানুষের কোনও নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। যখন তখন ইন্টারনেট থেকে শুরু করে ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া কাশ্মীরের মানুষের জীবনে যেন স্বাভাবিক ঘটনা।
এর মধ্যেই দিল্লি থেকে বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছে কাশ্মীরে কারও বাবা অথবা মায়ের পরিবারের কোনও আত্মীয়ের বিরুদ্ধে জঙ্গি যোগের সামান্য অভিযোগ থাকলেই সেই পরিবারের কেউই কোনও দিন সরকারি চাকরির জন্য আবেদনই করতে পারবেন না। এমনকি কেউ যদি সরকার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেমে থাকে সেটাও হবে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের ক্ষেত্রে পর্যন্ত সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। কোনও মিছিল থেকে পুলিশের দিকে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগকেও সন্ত্রাসবাদের সাথে এক করে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে এমন পরিবার বিরল যার কোনও না কোনও আত্মীয়ের বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনও মামলা নেই। ঘটনা হল বহু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত পর্যন্ত স্বীকার করেছে এই সব মামলার অনেকগুলিই ভুয়ো অভিযোগে করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ অনেকটা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের চালু করা পিটুনি করের মতো। একজনের অপরাধে তার সমগ্র পরিবার ও আত্মীয়দের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোন ধরনের গণতান্ত্রিক আইন? ন্যায়বিচারের কথা যদি ছেড়েও দেওয়া হয়, একটা দেশের সরকার তার নাগরিকদের ওপর এই রকম একটা ফতোয়া চাপিয়ে দিচ্ছে– সভ্য দুনিয়ায় এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাস্তবে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের জনগণকে নতুন করে আঘাত দেবে, যা বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়তেই সাহায্য করবে। এখন দরকার কাশ্মীরের যুব সমাজের কর্মসংস্থানে সরকারের আন্তরিকতা। দরকার সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের হাত থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য বিশ্বাস অর্জন করা। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। এর মধ্য দিয়েই একমাত্র সরকার জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বিজেপি সহ যে কোনও শাসক দলের কাছ থেকেই তা আশা করা বৃথা। তারা শাসন করা বলতে বোঝে গায়ের জোরের সামনে মানুষকে নত রাখা, যাতে কেউ শোষণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে না পারে। মহান সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ শাসকদের দেখে বলেছিলেন, শোষণের জন্যই শাসন, না হলে তার অন্য কোনও প্রয়োজন নেই। আজ ভারত সরকারকে দেখলে বোঝা যায় শাসকের চরিত্র বদলায়নি।
কাশ্মীরের মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন দেখে কেউ কেউ এই রাজ্যকে স্বাধীন করার কথা ভাবেন, কেউ আবার কাশ্মীরের মানুষের ক্ষোভ দেখে মনে করেন গায়ের জোরে কাশ্মীরকে দাবিয়ে রাখলেই সমস্যার সমাধান হবে। বিজেপির প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় নাগরিকদের একটা অংশ মনে করেন, কাশ্মীরের মানুষ বোধহয় পাকিস্তানের প্রতি সহানভূতিশীল। কিন্তু পাক অধিকৃত কা¬শ্মীরের জনগণের ওপর পাকিস্তান প্রশাসনের দমন-পীড়ন দেখিয়ে দিচ্ছে বাস্তবে তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এটা আসলে বিজেপি আরএসএস-এর কল্পিত অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তির দাবি সবচেয়ে বেশি করে তুলেছিল কাশ্মীরের জনগণ। কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেস-বিজেপির মতো শাসকদলগুলির ভূমিকাই সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদের জমি তৈরিতে সাহায্য করেছে। ১৯৫০ সালে মুম্বইয়ের ‘কারেন্ট’ পত্রিকায় ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার খাজা মহম্মদ আব্বাস লিখেছিলেন, ভারত সরকার যদি কাশ্মীরের মন জয় করতে চায়, তাহলে নীতিনিষ্ঠভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখে জনমুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচি তাদের আঁকড়ে ধরতে হবে (সূত্রঃ গান্ধী উত্তর ভারত, রামচন্দ্র গুহ)। ঠিক এই কাজটাই কোনও সরকার করেনি।
বোঝা দরকার, তথাকথিত স্বাধীন কাশ্মীর, পাক অধিকৃত কাশ্মীর কিংবা ভারতভুক্ত কাশ্মীর যেটাই হোক না কেন, বুর্জোয়া শ্রেণির একটি দল বা তাদেরই জোট শাসন চালালে তা পরিচালিত হবে বুর্জোয়া শাসকদেরই স্বার্থে। তাতে জনসাধারণের ওপর জুলুম, তাদের শোষণ করার কাজটা একই রকম হয়। সে কারণেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে উপজাতি, ভাষা পরিচয় নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ওপর সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকার জুলুম চালায়। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের কোনও প্রতিনিধি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সংসদে না থাকায় কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত তাদের ওপর রাষ্ট্র চাপিয়ে দেয়। অনেকটা একই কায়দায় কাশ্মীরের মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার সময় ভারত সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের বসানো লেফটেন্যান্ট গভর্নরকেই কাশ্মীরের জনগণের প্রতিনিধি সাজিয়ে দেয়। কাশ্মীরের মানুষের কোনও মতামত নেওয়ার তোয়াক্কাই কখনও কোনও কেন্দ্রীয় সরকার করেনি, আজও বিজেপি তা করছে না। বোঝা দরকার, ভারতের বিপুল সংখ্যার খেটে খাওয়া মানুষের সমস্যার সাথে কাশ্মীরের মানুষের মূলগত কোনও পার্থক্য নেই। এই সত্যটা সে রাজ্যের মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে গেলে তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবির পাশে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে গণআন্দোলন। অন্যান্য রাজ্যের খেটে-খাওয়া মানুষের দাবি নিয়ে গণআন্দোলনের মধ্যেও কাশ্মীরের মানুষের ওপর সরকার ও বুর্জোয়া শ্রেণির জুলুমের কথা তুলে ধরতে হবে। একমাত্র এই পথেই গড়ে উঠতে পারে ভারতের সমগ্র খেটে-খাওয়া জনগণের সাথে কাশ্মীরের জনগণের ঐক্য। বিজেপি নেতারা নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে মাঝে মাঝে সামরিক তাকতের জোরে পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ফিরিয়ে আনার হুঙ্কার দেন। যদিও সে অংশের জনগণের আস্থা অর্জনের পথও হল একমাত্র খেটে-খাওয়া মানুষের ঐক্য। যে ঐক্য সম্পূর্ণভাবে অর্জিত হতে পারে একমাত্র শোষিত-মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষাকারী সমাজেই।
ভারত কিংবা পাকিস্তান কাশ্মীরের উভয় অংশের মেহনতি জনগণ নিজেদের শ্রেণিগত প্রকৃত স্বার্থ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেই একমাত্র এই ঐক্য অর্জিত হতে পারে।