এ দেশে কি তাহলে ধর্ম দেখেই এখন বাকস্বাধীনতা নির্ধারিত হবে?

বিজেপি-শাসিত ভারতে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার যে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে, তা নিয়ে সচেতন গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আজ আর বিশেষ সংশয় থাকার কথা নয়। সম্প্রতি অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ ও মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মন্ত্রী বিজয় শাহের প্রায় একই সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা দুটি আরও স্পষ্ট করে দিয়ে গেল যে, মত প্রকাশের সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকারটি শুধু লঙ্ঘিত হচ্ছে তাই নয়, আজ তা নগ্নভাবে বৈষম্যমূলক হয়ে উঠেছে।

অপারেশন সিঁদুরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানোর জন্য সাংবাদিক বৈঠকে সেনাবাহিনীর যে দু’জনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক মহিলাকে এই গুরুদায়িত্ব দেওয়ায় অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। তারই সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘কর্নেল কুরেশিকে অনেক দক্ষিণপন্থী মানুষ প্রশংসা করছেন দেখে ভাল লাগছে। কিন্তু তাঁরা বোধহয় একই রকম উচ্চস্বরে এটাও দাবি করতে পারতেন যে, গণপিটুনি, বুলডোজার দিয়ে ইচ্ছেমতো ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং বিজেপির ঘৃণাভাষণের কারণে যাঁরা দুর্গত হয়ে পড়ছেন, ভারতীয় নাগরিক হিসাবে তাঁদেরও নিরাপত্তা দেওয়া উচিত’’ (দ্য প্রিন্ট, ২০ মে, ‘২৫)। ওই পোস্টে তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘‘দুই মহিলা সেনা তাঁদের মতামত জানানোর সুযোগ পেয়েছেন– এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তব জীবনেও এই গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটা উচিত, না হলে তা হয়ে যায় ভণ্ডামি’’ (ওই)।

এই পোস্টে অধ্যাপক মাহমুদাবাদ কর্নেল সোফিয়া কুরেশি তথা ভারতের মহিলা সেনাদের অমর্যাদা করেছেন এই অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেন হরিয়ানা রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রধান এবং বিজেপির যুব সংগঠনের এক নেতা। সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিজেপি-শাসিত হরিয়ানার পুলিশ। ভোরবেলা আচমকা অধ্যাপকের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করে তারা।

পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন তাঁকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি, এমনকি নিয়মিত ওষুধগুলি পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। পরে এই গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হলে অধ্যাপক মাহমুদাবাদের জামিন মেলে ঠিকই, কিন্তু তার আগে বিচারপতিরা তাঁকে ভৎর্সনা করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর জামিনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় অনেকগুলি শর্ত। যেমন, তাঁর পাসপোর্ট জমা দিতে হবে, মামলাধীন বিষয়ে তিনি কোথাও কোনও মন্তব্য করতে বা লিখতে পারবেন না এবং ডিজিপি স্তরের তিন পুলিশকর্তাকে নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গড়ে তাঁর ওই ফেসবুক পোস্টটির অন্তর্নিহিত অর্থ খতিয়ে দেখা হবে। অপরাধমূলক কিছু পাওয়া গেলে তাঁর জামিন বাতিল হয়ে যেতে পারে।

রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অধ্যাপক মাহমুদাবাদের গ্রেফতারি ও শেষ পর্যন্ত তাঁর পোস্ট নিয়ে সর্বোচ্চ বিচারালয়ের এই পদক্ষেপে দেশ জুড়ে শোরগোল উঠেছে। শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, চলচ্চিত্র পরিচালক সহ বহু বিশিষ্টজন অধ্যাপক মাহমুদাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন, বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। অধ্যাপক মাহমুদাবাদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে যা লিখেছেন, তাতে সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা, উগ্রতা বা নারীবিদ্বেষের কথা তাঁরা কেউই খুঁজে পাননি। তা ছাড়া, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক বিজ্ঞজনেরা যে পোস্ট পড়ে অধ্যাপকের শাস্তি বিধানের কারণ খুঁজে না পেয়ে তাঁকে জামিন দিয়েছেন, সেই পোস্টের অর্থ উদঘাটনের জন্য কেন বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের মতো একটি গুরুতর পদক্ষেপ নিতে হল তাঁদের, এ প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি শাসক বিজেপির রোষানলে পড়া এই অধ্যাপকের বাক-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কেও দু’পা পিছিয়ে যেতে হল!

অথচ ওই একই সময়ে, অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করা সত্ত্বেও এক বিজেপি মন্ত্রীর ক্ষেত্রে কিন্তু সরকারের ঠিক বিপরীত আচরণ নজরে এল। যুদ্ধোন্মাদনার প্রবল স্রোতের পাশাপাশি বিজেপি-আরএসএসের প্রচারবাহিনী ও কিছু সংবাদমাধ্যমের উচ্চগ্রামের ঢাক পেটানোয় যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ ও দেশপ্রেমকে প্রায় সমার্থক করে তোলা হয়েছে, তখন কর্নেল সোফিয়া কুরেশির ধর্মবিশ্বাসকে ইঙ্গিত করে বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশের এক মন্ত্রী বিজয় শাহ তাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের বোন’ বলে অভিহিত করেছেন। স্পষ্টতই এই মন্তব্য শুধু সেনাবাহিনীর এক পদস্থ অফিসারের প্রতিই নয়, গোটা সেনাবাহিনীর প্রতিই অপমানজনক। অথচ মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারকে এমন ঘটনার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল না। এই মন্তব্য ঘিরে সমাজ জুড়ে প্রবল শোরগোল উঠলে রাজ্যের হাইকোর্টকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয় হতে হয়, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। সুপ্রিম কোর্টের অন্য একটা বেঞ্চ তাকে তীব্র ভৎর্সনা করেছেন। লক্ষণীয় হল, তা সত্ত্বেও কিন্তু বিজয় শাহকে গ্রেফতার করেনি বিজেপি সরকারের পুলিশ। নিজের মন্তব্যের জন্য দায়সারা ভাবে ক্ষমা চেয়ে ওই মন্ত্রী আজও বহাল তবিয়তে বাক-স্বাধীনতার অধিকার ভোগকারী একজন মুক্ত নাগরিক হিসাবে দিন কাটিয়ে যাচ্ছেন।

এই অবস্থায় দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ প্রশ্ন তুলছেন– মাত্র কয়েক দিনের ফারাকে অধ্যাপক মাহমুদাবাদ ও মন্ত্রী বিজয় শাহের প্রতি সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনের আচরণে এই বৈষম্য থেকে কি এটাই স্পষ্ট হয়ে যায় না যে, মত প্রকাশের অধিকার দেশের মানুষ ভেদে, বিশেষত তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় ভেদে এখন ভিন্ন রকমের? সমাজমাধ্যমে নিতান্ত সাধারণ একটি মন্তব্যকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে দাগিয়ে দিতে বাধছে না যে বিজেপি সরকারের, তারাই আবার সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসারকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের বোন’ বলে অভিহিতকারীর বিরুদ্ধে নীরব!

 সময় এসেছে এই চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। না হলে, গোটা দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার থাকবে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক শাসকের পেটোয়া ব্যক্তিদের। গণতন্ত্র ও শুভবোধের প্রকাশ দেশের বুকে আজও যেটুকু টিকে আছে, সরকার ও তার প্রশাসন সেখানে কুলুপ এঁটে দেবে।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত