বছর তিরিশের শীলা সরেন। ছিলেন মেদিনীপুর শহরের এক নম্বর ওয়ার্ডের বস্তিবাসী। পৌর নির্বাচনের ঠিক দু’দিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন। অথচ রাজ্যের শাসক দলের ভোটের মিছিলে হেঁটেছিলেন তিনি। ভোটের দিনটা না দেখেই জ্বালা জুড়োলেন নিজের হাতে! কী সেই দুর্বিষহ জ্বালা, যা তাঁকে বাঁচতে দিল না? সমস্যাটা খুব চেনা–সীমাহীন দারিদ্র আর মদ্যপ স্বামী। অসংখ্য দিন আনা-দিন খাওয়া পরিবার যাতে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে।
চার সন্তানের মা শীলা। বড়টির বয়স দশ আর কনিষ্ঠটির বয়স মাত্র দেড় বছর। নিজে শহরের চারটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে বাচ্চাদের কোনও রকমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ত্রিপলের ছাউনি ও অ্যাসবেস্টসের ঠেকনা ঘেরা কিছুটা জায়গা। এ বছরের বৃষ্টিতে গৃহস্থালির যাবতীয় ভেসে গেছে। বাচ্চাদের নিয়ে কোনওরকমে ঠায় দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়েছেন। হাঁড়ি চড়েনি চার পাঁচ দিন। এরকম অসহায় জীবন যাপন। স্বামীর রোজগার নেই। দু’বছরের করোনা, লকডাউন এসবের কারণে দিনমজুরি জোটাও কঠিন। কিন্তু দিনের শেষে খাওয়া জুটুক না জুটুক, মদ তার চাই।
শীলা ভোট দিতেন, শাসক দলের হয়ে মিছিলেও যেতেন। একটি মাত্র প্রতিশ্রুতি পেতে, সরকারি প্রকল্পে একটা ঘর পাবেন। মাথা গোঁজার একটা স্থায়ী আচ্ছাদন হবে। সেই আশায় এবারও মিছিলে হেঁটেছিলেন শীলা ও তার স্বামী। হাতে পঞ্চাশ, একশো টাকা পেয়েই স্বামী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ঢোকে। সেই নিয়ে অশান্তি চরমে পৌঁছায়। শীলা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করলে স্বামী তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও পুড়ে যান। শীলা মারা যান একদিন পর। আর তাঁর স্বামী হাসপাতালে কয়েকদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চোখ বোজেন। চারটি শিশু কী করবে? কেউ জানে না। যথারীতি শীলাদের খোঁজ নিতে শাসকদলের নেতা দূরের কথা, ছোটখাটো স্থানীয় নেতারাও তাদের ত্রিসীমানার ছায়া মাড়াননি আজ পর্যন্ত। কেনই বা যাবেন? জীবনের সামান্য একটু সুরাহার আশায় ক্ষমতাসীন দলের নেতার পিছনে হাঁটা অসহায় শীলা কতই না আছে!
রাজ্য সরকার এখন ব্যস্ত শীলার মতো এমন পরিবারগুলোর ‘দুয়ারে মদ’ পৌঁছে দিতে। তাতে সরকারের আয় বাড়বে। সরকারি নেতা-মন্ত্রী কর্তাদের জন্য প্রাইভেট প্লেন ভাড়ার সংখ্যা কিংবা মেলার জৌলুস বাড়বে। মদ বেচে এত লাভ যে, এটাই এখন সরকারের প্রধান রাজস্ব আদায়ের উৎস। আর তার সাথে আছে লাইসেন্সে অথবা বিনা লাইসেন্সে চলা মদ কারখানা, মদের দোকান, ভাটিখানা কিংবা চোলাইয়ের ঠেক থেকে আদায় হওয়া কমিশন। শাসকদলের ছোট, মেজো, সেজো থেকে বড় সব কর্তা এবং পুলিশের নানা স্তরে তার ভাগও ঢোকে তাও অজানা কোনও তথ্য নয়।
প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। শীলা তো আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছেন। কিন্তু যারা রইল? শীলার মতো আরও অসংখ্য মা এবং তাঁদের কন্যা সন্তানরা– তারা যখন মদ্যপদের লালসার শিকার হয়ে সম্ভ্রম এমনকি জীবনও হারাবে? কী করবেন তাদের মায়েরা, পিতারা?
তাঁদের কাছে আজ ডাক এসেছে জোট বাঁধার। জোট বেঁধে প্রতিরোধ করার। ২২ মার্চ শীলাদের যন্ত্রণা, তাদের আর্তনাদ বুকে নিয়ে অসংখ্য মানুষ নামবেন রাজপথে। সোচ্চারে দাবি তুলবেন, এখনই রাজ্য সরকার মদ নিষিদ্ধ করো। শীলা সরেনের ধ্বংস হওয়া পরিবার আর অনাথ সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়ে এ দাবি তোলা কর্তব্য আজ সকলের।