১৯৬৯ সাল৷ পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্টের শাসনকাল৷ শ্রেণিভিত্তিক ফ্রন্টের আজগুবি তত্ত্ব আওড়ে সিপিএম তখন শরিক দলগুলির এলাকা দখল করার অভিযানে নেমেছে৷ সিপিএমের এই কার্যকলাপে বামপন্থাই যে কলুষিত হচ্ছে এবং বামপন্থী আন্দোলনের মর্যাদাকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে, যার পরিণাম অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে বাধ্য, এই হুঁশিয়ারি দিয়ে এস ইউ সি আই (সি)–র তদানীন্তর সাধারণ সম্পাদক, মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জনসংঘের মতো ধর্মীয় রাষ্ট্রীয়তাবাদীরা ওৎ পেতে বসে আছে৷ তারা সুযোগের অপেক্ষা করছে৷ বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ আজও রয়েছে তা নষ্ট হয়ে গেলেই তারা আত্মপ্রকাশ করবে৷ এ কথাটা ক্ষমতাসীন সিপিআই(এম) নেতারা বুঝছেন না৷ তাঁরা কমিউনিজমের আদর্শ, মূল তত্ত্ব বাদ দিয়ে প্রায় কংগ্রেসেরই মতন বড় বড় বুক্নি আর মিষ্টি কথার চালাকিতে জনতাকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন৷ এইভাবে কমিউনিজমের সুনামকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে কালিমালিপ্ত করছেন৷’’*
ঠিক সেটাই ঘটল৷ পরবর্তী কালে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে ২০১১ সাল পর্যন্ত সিপিএম বামফ্রন্টের নামে যে চূড়ান্ত অবাম শাসন চালিয়েছে তারই পরিণামে আজ পশ্চিমবাংলায় দক্ষিণপন্থী শক্তি মাথা তুলেছে প্রবল ভাবে৷
এই পরিস্থিতিতেও সিপিএমের ভূমিকা কী? সদ্য পার্টি কংগ্রেস থেকে তারা বিজেপিকে সর্বভারতীয় স্তরে প্রধান শত্রু ঘোষণা করেছে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করার নাম করে সেই বিজেপির সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য নির্বাচনী বোঝাপড়া করতে তাদের আটকাচ্ছে না৷ শুধু তাই নয়, ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ফ্রন্ট পরাস্ত হওয়ার পর থেকে, বিশেষত ২০১৬ সালে কংগ্রেস–সিপিএম জোট পরাস্ত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, দলে দলে সিপিএমের নেতা–কর্মীরা বিজেপির দল ভারি করছে৷ পশ্চিমবঙ্গে যে বিজেপির কোনও সাংগঠনিক শক্তি ছিল না, লোকবল ছিল না, সেই বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির পিছনে আরও অনেকের সাথে সিপিএম নেতা–কর্মীদের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই৷ এর দ্বারা বিজেপির শক্তিবৃদ্ধিতেই যে সিপিএম সাহায্য করছে, এ কথাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট৷
কিন্তু সিপিএমের ভূমিকা এখানেই শেষ নয়৷ বামপন্থার কবর খোঁড়ার পর এবারও তারা পশ্চিমবঙ্গে যেখানেই এস ইউ সি আই (সি)–র দখলে পঞ্চায়েত আছে, বা আসন্ন নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা আছে সেখানেই এস ইউ সি আই (সি)–কে পরাস্ত করার জন্য কোথাও তৃণমূল কংগ্রেস, কোথাও বিজেপি প্রার্থীকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সমর্থন করছে, মদত দিচ্ছে৷ এটা কোন ধরনের বামপন্থা? বামপন্থা মানে তো একটা উন্নত আদর্শ৷ তাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে শুধু ভোটে জিতলেই কি দক্ষিণপন্থার শক্তিবৃদ্ধি রোখা যায়!
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলতলির মৈপীঠ অঞ্চলের সঙ্গে রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে৷ ১৯৮৯ সালের ৯ ডিসেম্বর সশস্ত্র খুনি বাহিনী নিয়ে সিপিএম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এস ইউ সি আই (সি) কর্মী–সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি৷ হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছিল সাগরের জলে৷ একটানা অত্যাচার ও সন্ত্রাসে এস ইউ সি আই (সি)–র বহু কর্মী–সমর্থক আজও পঙ্গু৷ বাইরের জগতে এই অত্যাচারের কাহিনি আসেনি৷ এই বীভৎস মর্মান্তিক স্মৃতি বহন করে চলছেন শুধু মৈপীঠের মানুষ৷ মৈপীঠ অঞ্চল পঞ্চায়েতে গত নির্বাচনে এস ইউ সি আই (সি) জয়ী হয়৷ এ বার ১৯টি আসনেই এস ইউ সি আই (সি)কে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে সিপিএম তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে প্রকাশ্যেই জোট বেঁধেছে৷ দেওয়াল লিখছে দুই দলের নির্বাচনী চিহ্ণ দিয়ে৷ এ কেমন বামপন্থা? এর দ্বারা কোন বামপন্থী রাজনীতিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে? এ যারা করতে পারে দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে তাদের পক্ষে কি কোনও লড়াই করা সম্ভব? সিপিএমের সৎ কর্মী–সমর্থকরা ভেবে দেখবেন
নদিয়া জেলার পলশুন্ডা–১ পঞ্চায়েতে গত নির্বাচনে এস ইউ সি আই (সি) জয়ী হয়৷ এখানেই ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের দিন ২৯ মে এলাকার মানুষের অত্যন্ত প্রিয়জন, এস ইউ সি আই (সি)–র সংগঠক কমরেড আবদুল ওদুদকে সিপিএমের লোকেরা আলোচনার নাম করে পঞ্চায়েত অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করে তাঁর দেহ পঞ্চায়েত অফিসের সামনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল৷ গ্রামে গ্রামে কান্নার রোল উঠেছিল সেদিন৷ সিপিএমের এই অপরাধকে এলাকার মানুষ ক্ষমা করতে পারেননি৷ সেই পলশুন্ডা–১ পঞ্চায়েতে এবার তৃণমূলের সঙ্গে তো বটেই, এমনকী বিজেপির সঙ্গেও সিপিএম আঁতাত করেছে এস ইউ সি আই (সি)কে হারাবার জন্য৷ সিপিএম সমর্থিত বিজেপি প্রার্থীর হয়ে দেওয়াল লেখাও হয়েছে৷ এ কেমন বামপন্থা? তৃণমূলকে পরাস্ত করার নামে তারা বিজেপির সঙ্গে জোট করছেন– এ হচ্ছে একটা দিক৷ কিন্তু সেই সিপিএমই যে সংগ্রামী বামপন্থী দল এস ইউ সি আই (সি)কে হারাবার জন্য দক্ষিণপন্থী তৃণমূল তো বটেই, এমনকী মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক বিজেপির সঙ্গেও আঁতাত করতে পিছপা হচ্ছে না– এ হল সিপিএমের রাজনীতির দেউলিয়াপনার আর একটি বৈশিষ্ট্য৷
আমাদের একটাই প্রশ্ন, এ কেমন বামপন্থা? এর দ্বারা তাঁরা কাদের শক্তিশালী করছেন?
* শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলি, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা–১১১
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)