ডিসেম্বরে দু’দফায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচন। গত ২৭ বছর ধরে সেখানে সরকারি ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। রাজ্যে সরকারে বসার পর থেকেই বিজেপি উন্নয়নের ‘গুজরাট মডেল’ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে চলেছে। অথচ গত কয়েকমাস ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কার্যত পড়ে থাকতে হচ্ছে গুজরাটের মাটি কামড়ে। তাঁকে প্রচারের সুযোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনও হিমাচল প্রদেশের ভোট ঘোষণার পর বেশ কিছু দিন সময় নিয়ে গুজরাটের ভোট ঘোষণা করেছে। গত দু-তিন মাসে প্রধানমন্ত্রী গুজরাটে যত প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন, তার তালিকা বিরাট লম্বা। সারা বছর ফাঁকি দিয়ে টেস্টের পর বই খুলে বসা ছাত্রের মতো তাঁর দশা। নরেন্দ্র মোদি তা জানেন বলেই পুরনো মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে ৪২ জন এমএলএ-কে প্রার্থী তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলেছেন। দেখানোর চেষ্টা করছেন এবার যেন নতুন বিজেপি! রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে সকল ক্ষোভ চাপা দিতে তিনি বলে চলেছেন ‘এই গুজরাট আমি বানিয়েছি’।
কেমন বানিয়েছেন তিনি এবং তাঁর দল গুজরাটকে?
সারা দেশেই আজ বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ। গুজরাট তার ব্যাতিক্রম নয়। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাটে’ ভোট প্রচারে প্রার্থীরা গেলেই মানুষ তাঁর বাসস্থান এলাকার নোংরা পরিবেশ, নিকাশি ব্যবস্থা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ জানাচ্ছেন। জানাচ্ছেন আলোহীন রাস্তাঘাট ও সেখানে অবাধে চরতে থাকা গবাদি পশুর কারণে ভোগান্তির কথা। কয়েকদিন আগেই ঘটে গেছে মোরবি সেতুর মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। মৃত্যু হয়েছে ১৪১ জনের। দিনের পর দিন কেটে গেলেও ব্রিজটির নির্মাতা সংস্থার মালিককে গ্রেফতার করেনি গুজরাট পুলিশ। তা নিয়েও ক্ষোভ জানাচ্ছেন মানুষ। নিত্যদিনের অজস্র সমস্যায় এমন ভাবে জেরবার হয়ে রয়েছেন তাঁরা যে, অধিকাংশেরই যেন এ সবের বাইরে আর কিছু ভাবারই ফুরসৎ নেই! জীবনযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাঁদের সামনে নগ্ন হয়ে যাচ্ছে ‘গুজরাট মডেল’-এর বীভৎস চেহারা।
মূল্যবৃদ্ধি
গোটা দেশের মতো গুজরাটের মানুষও মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়ছে। গত কুড়ি বছরে রাজ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম চারশো শতাংশ বেড়ে গেছে। রাজ্যের বিজেপি সরকার চাইলে এই চরম মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এমন নয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বিষয়ে তাদের কোনও সদিচ্ছা দেখা যায়নি। ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষকে লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করতে গত অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। এরই সঙ্গে চলছে অন্য দলের এমএলএ এমপি-র অবাধ কেনাবেচা। চলছে ভোটারদের মধ্যে জাতপাত সম্প্রদায় ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টি করার বিজেপির চিরাচরিত খেলা।
ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যা
গুজরাটের যুবসমাজ ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যায় ভুগছে। কোভিড অতিমারির পর অবস্থা আরও দুর্বিষহ হয়েছে। কাজ না পেয়ে গুজরাট রাজ্যে গত দু’বছরে প্রতিদিন প্রায় কুড়ি জন কর্মহীন যুবক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বেকার সমস্যা সমাধানের দাবিতে রাজ্য জুড়ে নানা বিক্ষোভ হয়েছে। গুজরাটের বিজেপি সরকার সেই বিক্ষোভ লাঠি-গুলি দিয়ে বর্বরের মতো দমন করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে। উল্লেখ্য, বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে ১০ লক্ষ নিয়োগপত্র বিলি করার কথা ঘোষণা করেছেন, তা মিলেছে রাজ্যের মাত্র ৩৭৩ জনের।
শিক্ষার বেহাল দশা
গুজরাটের বিজেপি সরকার শিক্ষার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারিকরণ ও ব্যবসায়ীকরণের নীতি শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করেছে। রাজ্য জুড়ে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা একাধিক সরকারি স্কুলকে জুড়ে দেওয়া রাজ্যের দৈনন্দিন ঘটনা। এর উপর গুজরাটের বিজেপি সরকার এখন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যব্যবসার রমরমা
কোভিড অতিমারি গুজরাটের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভযঙ্কর চেহারা বেআব্রু করে দিয়ে গেছে। অতিমারি কালে কোভিড রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দূরের কথা, প্রয়োজনীয় পরিমাণে অক্সিজেন সিলিন্ডার পর্যন্ত সরবরাহ করতে পারেনি গুজরাটের বিজেপি সরকার। এই সময় রাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগে অসংখ্য কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে। এই সরকারের মদতে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা যেমন খুশি টাকা নিচ্ছে রোগীদের কাছ থেকে। এমনিতেই শিশু মৃত্যুর হার, প্রসূতিদের চিকিৎসা, জনসংখ্যা পিছু হাসাপাতালের বেডের নিরিখে গুজরাট বহু রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলিকে বন্ধ করে দেওয়ার প্রবল অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গুজরাটে বিজেপি সরকার।
মহিলাদের নিরাপত্তা নেই
গত পাঁচ বছরে গুজরাটে ৬ হাজার ৩১৬টি ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৭২টি গণধর্ষণের ঘটনা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাস্তবে মহিলাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা এর চেয়ে আরও অনেক গুণ বেশি। সম্প্রতি গুজরাট সরকার যেভাবে বিলকিস বানোর ধর্ষক ও দোষীদের মুক্তি দিল তাতে গোটা দেশে নিন্দার ঝড় উঠে গেছে। শিশু সহ একাধিক খুন ও নারী নির্যাতনের অসংখ্য মামলা বিচারাধীন হয়ে পড়ে রয়েছে মোদিজির ‘তৈরি’ গুজরাটে। ২০২১-এর শেষে দেখা যাচ্ছে মহিলাদের উপর নির্যাতনের বিচারাধীন মামলা ৯৬ হাজার ছাড়িয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির যে পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রক প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গোটা দেশের মধ্যে গুজরাটেই কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ধন্য মডেল রাজ্য! রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবে মদের রমরমায় অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ।
শ্রমিকদের অমানবিক পরিস্থিতি
শ্রমিকদের প্রতি রাজ্যের বিজেপি সরকারের আচরণ দেখলে স্পষ্ট হয় যে, শ্রমিকদের এই সরকার মানুষ বলে মনে করে না। দীর্ঘ ২৫ বছর এ রাজ্যে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়নি। ২৫ বছর পর যেটুকু বাড়ানো হয়েছে তাও অতি সামান্য। কলে-কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় যে সমস্ত শ্রমিকের জীবন চলে যাচ্ছে বা যাঁরা আহত হচ্ছেন, তাদের পরিবারের প্রতি কোনও রকম সহানুভূতির চিহ্ন দেখায় না এ রাজ্যের বিজেপি সরকার। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমবিরোধী যে লেবার কোড নিয়ে এসেছে গুজরাটে তা ব্যাপকভাবে চালু করে শ্রমিক শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে এখানকার বিজেপি সরকার।
কৃষক সমাজের করুণ দশা
রাজ্যে কৃষকদের অবস্থাও যথেষ্ট করুণ। দিল্লি সীমান্তে দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার জনবিরোধী কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেও গুজরাটে বিজেপি সরকার অবাধে সেগুলোর ঢালাও প্রয়োগ করে চলেছে।
আদিবাসী ও দলিতদের প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি নেই গুজরাট সরকারের
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, তাঁর এবিসিডি বর্ণমালাতে প্রথম অক্ষর ‘এ’ বলতে আদিবাসীদেরই তিনি বোঝান। কিন্তু গুজরাট রাজ্যে আদিবাসী ও দলিত সমাজের মানুষের অবস্থা দেখিয়ে দিচ্ছে আজও এঁরা মধ্যযুগীয় অনুন্নত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। সম্প্রতি পার-তাপি-নর্মদা সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাজ্যের আদিবাসী জেলা ডাঙ প্রবল বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল। প্রথম যখন এই প্রকল্পের কথা ঘোষণা হয় তখন এস ইউ সি আই (সি)-র নেতৃত্বে এলাকার মানুষ জোরদার আন্দোলন চালিয়েছিলেন। সেই আন্দোলনের চাপে প্রকল্পটি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। এখন আবার নতুন করে ওই প্রকল্প চালু করার কথা ঘোষণা করলে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন আদিবাসীরা। গুজরাট রাজ্যটিতে দলিত ও আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগতই বেড়ে চলতে দেখা যাচ্ছে। রাজ্যের বিজেপি সরকার যে এই মানুষগুলিকে শুধুমাত্র তাদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে দেখে, এদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য তাদের যে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই– দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে কথা।
সীমাহীন দুর্নীতি
গুজরাটে বিজেপি সরকারের দুর্নীতির গভীরতা কেমন তা দেখিয়ে দিয়ে গেছে মোরবি সেতু দুর্ঘটনা। আজ বোঝা যাচ্ছে কাটমানির জোরে কোনও নিয়ম মানার তোয়াক্কাই করেনি কনট্রাক্টররা। এই দুর্ঘটনার জন্য অভিযুক্ত বিজেপি এমএলএ-কে জেলে ভরা দূরে থাক সেই জয়সুখ ভাই প্যাটেলকেই বিধানসভার টিকিট দিয়েছে বিজেপি। কোভিডের সময় জাল ভেন্টিলেটর বেচেও ছাড় পেছে গেছে বিজিপি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। গত এক বছরে সরকারি দপ্তরে ১৭৩টি দুর্নীতির ঘটনা সামনে এলেও তার তদন্ত কী হল কেউ জানে না। নোট বাতিলের সময় বিজিপি-র প্রাক্তন এমএলএ সচিন ওঝা কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা সরকার নেয়নি। গুজরাটের সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে কয়েক শত কোটি টাকার দুর্নীতির খবর সামনে এলেও সরকারের হেলদোল নেই।
মহান মার্ক্সবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষার ভিত্তিতে গুজরাটে এসইউসিআই(সি) দলের কর্মীরা নির্বাচনী প্রচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। বিধানসভা নির্বাচনের এই সুযোগটিকে তাঁরা পচা-গলা সংসদীয় ব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটনের কাজে ব্যবহার করছেন। নোংরা, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক আবহের মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে উন্নত নীতি-নৈতিকতা ও সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রাম চালাচ্ছেন তাঁরা। জনসাধারণের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ যে এই মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সেই সত্য তাদের কাছে তুলে ধরছেন কর্মীরা। পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের নির্বাচিত করে গণআন্দোলনের শক্তিকে আরও জোরদার করার আবেদন জানাচ্ছেন। রাজ্যের জনবিরোধী বিজেপি সরকারকে পরাজিত করতে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে আহ্বান জানিয়েছে এস ইউ সি আই (সি) নেতৃত্ব।