এ কেমন আর্থিক বৃদ্ধি, যাতে অভাব বাড়ে!

 

কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৮ সালের প্রথম তিনমাসে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে৷ কিন্তু কী উপায়ে তাঁরা এই আর্থিক বৃদ্ধি মাপলেন? পদ্ধতিটা জটিল৷ মোদ্দা কথা হল, সারা দেশের বাজারে নানা জিনিস কিনতে বা পরিষেবা পেতে মানুষ যা মোট ব্যয় করে তার গড় করে মাপা হয় জিডিপি বা গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন৷ তার ওঠা–পড়ার হারকে ধরেই সরকারি বাজার বিশেষজ্ঞরা আর্থিক বৃদ্ধি মেপে থাকেন৷

রিপোর্ট বার হওয়া মাত্র কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নেতা মন্ত্রীরা হইহই করে বলতে শুরু করে দিয়েছেন, নোট বাতিলের ফলে দেশে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল তার মেঘ কেটে গেছে৷ এবার অর্থনীতি একেবারে রকেট গতিতে দৌড়বে পরিসংখ্যান দেখিয়ে বিজেপি নেতারা না হয় আহ্লাদে একেবারে আটখানা হয়েছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা কী বলছে? ছোট–ছোট দোকান, কল–কারখানা, তাদের অবস্থা কি ভাল হয়েছে? ছোট ব্যবসার বাজার সংকট কেটেছে? খেটে খাওয়া মানুষের ঘরে কী সমৃদ্ধির ছাপ লেগেছে? কর্মসংস্থানের সুযোগ কি দেশে বেড়েছে? এর কোনও একটিরও উত্তরের জন্য কোনও অর্থনীতির পণ্ডিতের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার নেই৷ একেবারে নিতান্ত সাধারণ মানুষ এক নিঃশ্বাসে বলে দেবেন, সবকটি প্রশ্ণের একটিই উত্তর, তা হল, না৷

তাহলে আর্থিক বৃদ্ধি কি কারও ক্ষেত্রে ঘটেনি? বিজেপি সরকারের নীতিতে এ দেশের বড় বড় মালিকদের উল্লাস আর সাধারণ মানুষের আর্তনাদ দেখে বুঝতে বাকি থাকে না বৃদ্ধিটা কাদের বৃদ্ধির হিসাব দেখলেও বিষয়টা কিছুটা পরিষ্কার হয়৷ পরিকাঠামো শিল্পে বৃদ্ধি ৫.৩ থেকে কমে ৪.১ শতাংশ হয়েছে৷ মূল শিল্পগুলির উৎপাদনের হারও বাড়েনি, বরং কিছুটা কমেছে৷ কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশের বেশি ওঠেনি৷ তাহলে বেড়েছে কী? কীসে বাড়ল দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার?

বেড়েছে সরকারি কোষাগারের ব্যয়৷ তার বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৮.৩ শতাংশ৷ তাতেই গড়ের অঙ্কে মোট আর্থিক বৃদ্ধি বেড়েছে৷ কিন্তু সরকার তো সাধারণ মানুষের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে ব্যয় ক্রমাগত কমাচ্ছে, তাহলে সরকারি ব্যয় বাড়ল কোথায়? এখানেই জিডিপি বৃদ্ধির হিসাবের ম্যাজিকটা লুকিয়ে আছে৷ সরকার প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয় বাড়িয়েছে৷ বেড়েছে অস্ত্র তৈরির কারখানা খোলার জন্য বা অন্য কোনও শিল্প করার অজুহাতে বৃহৎ শিল্পপতিদের জন্য ভরতুকি৷ বৃহৎ শিল্পপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করেনি, তাদের জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় সরকার যে দফায় দফায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে তার হিসাবও ধরা আছে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির হিসাবে৷ তার সাথে আছে এমপি–আমলাদের আকাশ ছোঁয়া বেতন বৃদ্ধির হিসাব৷ অর্থাৎ এই সরকারি ব্যয় কোনও সম্পদ সৃষ্টি করেনি৷ ১০০ দিনের কাজের জন্য টাকা বাড়াতে সরকারের কোষাগারে টান পড়ে, শিক্ষা খাতে ব্যয় ক্রমাগত কমছে৷ যে বিপুল সরকারি ব্যয়ের কারণে জিডিপির গড় এত বেড়ে গেল, তা জনগণের কোন কাজে লাগবে?

তাই যত আর্থিক বৃদ্ধির হিসাবের বহর বাড়ে, তত বাড়ে জনসাধারণের বেকারি ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধির বোঝা বাড়ে, শিক্ষা স্বাস্থ্যের বিপুল খরচের বোঝা চাপে মানুষের ঘাড়ে৷ তথাকথিত আর্থিক বৃদ্ধির হিসাবই দেখিয়ে দেয়, এই বুর্জোয়া ব্যবস্থায় পঁুজিপতিদের পৌষমাস হলে জনগণের সর্বনাশ হবেই৷ এ সত্য ভুলে গেলে চলবে না৷

(৭০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা ২২ জুন, ২০১৮)