ওড়িশার ভুবনেশ্বরে পিএমজি স্কোয়ার। ১৫ ডিসেম্বর ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মচারী সমবেত হয়েছিলেন বিপ্লবী শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের ২২তম সর্বভারতীয় সম্মেলনেরপ্রকাশ্য অধিবেশনে। কণ্ঠে তাঁদের দৃপ্ত ঘোষণা– কেন্দ্রের শ্রম কোড বাতিল করতে হবে। শ্রমিকের স্বার্থ বিপন্ন করে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার সরকারি জনবিরোধী নীতি বাতিল করতে হবে।
দেশের ২৪টি রাজ্য এবং কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে মুক্তিকামী শ্রমজীবী মানুষ লাল পতাকায় সজ্জিত, অসংখ্য গণতান্ত্রিক দাবি সংবলিত ব্যানার নিয়ে রাজমহল স্কোয়ার থেকে মিছিল করে বিধানসভা ভবনের সামনে পিএমজি স্কোয়ারে পৌঁছায়। এই শ্রমিক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি মিস্টার মাইকেল। উপস্থিত ছিলেন প্যালেস্টাইন, নেপাল, বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ছিলেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের বিপ্লবী চিন্তাধারার পতাকা বাহক এ আই ইউ টি ইউ সি-র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
সংগঠিত, অসংগঠিত শ্রমিক-কর্মচারী ছাড়াও নতুন করে শ্রমের বাজারে আসা গিগ ওয়ার্কার্স বা প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার্সরা বিপুল সংখ্যায় সামিল হয়েছিলেন এই সমাবেশে। সমবেত শ্রমিকদের সামনে ডব্লিউ এফ টি ইউ-এর সভাপতি আবেগদৃপ্ত ভাষণে বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সর্বগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী শ্রেণিভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলুন। প্যালেস্টাইনের জনগণের উপর ইজরায়েলের বর্বর আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন তিনি। অভিনন্দন জানান এ আই ইউ টি ইউ সি-কে, যারা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম করছে। প্রকাশ্য অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের ওড়িশা রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়সেন মেহের, সংগঠনের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি কমরেড সত্যবান, কমরেড স্বপন ঘোষ এবং সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড অরুণ সিং, সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলেন, ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার শ্রমিকদের অধিকারগুলি একে একে হরণ করছে। সমাবেশের সভাপতি সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ শ্রমিক কর্মচারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পুঁজিবাদ ও তার তল্পিবাহক সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে মানবসভ্যতাকে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ থেকে বাঁচানো যাবে না।
এদিন সন্ধ্যায় রয়াল রিসর্ট গ্রাউন্ডে প্রতিনিধি অধিবেশন শুরু হয়। সারা দেশ থেকে নির্বাচিত ১১০৫ জন শ্রমিক নেতা নানা অংশের শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এখানে ডব্লিউ এফ টি ইউ-র মাইকেল ছাড়াও প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধি হোসাইন কারাসবা, অল নেপাল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ওপেন্দ্রকুমার রায় এবং টিকারাম পরসাই, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের শেখর রায় বক্তব্য রাখেন। তাঁরা তাদের মূল্যবান ভাষণে শ্রমিক আন্দোলনে শোষণমুক্ত মানবসমাজের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ব্যক্ত করেন।
বিদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন দক্ষিণ আফ্রিকার সিওএসএটিইউ, বাংলাদেশের বিইউইএফ, চিনের এসিএফটিইউ, জাম্বিয়ার এফএফটিইউজেড, নিউজিল্যান্ডের এনপিএফইউ এবং মরিশাসের ট্রেড ইউনিয়নের পাঠানো সংহতি বার্তা পড়ে শোনান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর দাশগুপ্ত। বার্তাগুলির মধ্য দিয়ে বিশ্বের শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্য, চিন্তার আদান-প্রদান এবং বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিষয়গুলি উঠে আসে।
আমন্ত্রিত হয়ে ভারতের ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যে এআইটিইউসি, সিটু, এআইসিসিটিইউ এবং টিইউসিসি-র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছিলেন। ৪ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী দু’দিনের প্রতিনিধি অধিবেশন পরিচালনা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ, কমরেড সত্যবান, কমরেড শম্ভুনাথ নায়েক, কমরেড আর কুমার।
মূল প্রস্তাব, সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন, সংবিধান সংশোধনী এবং জনজীবনের জলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে আন্দোলন সংক্রান্ত ১৩টি প্রস্তাবের উপর প্রতিনিধিরা বিস্তারিত আলোচনা করেন। পরে তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। সাংস্কৃতিক অধিবেশনে প্রোগ্রেসিভ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার ওড়িশা রাজ্য শাখা বিপ্লবী গণসঙ্গীত পরিবেশন করে। নাটক, নৃত্য প্রভৃতি মঞ্চস্থ হয়। আগামী দিনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সম্মেলন থেকে কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ সভাপতি এবং কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১ সদস্য বিশিষ্ট সর্বভারতীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। ৯৬ সদস্যের কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়।
সমাপ্তি অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ মুনাফা করতে মুমূর্ষু পুঁজিবাদ শ্রমিক শ্রেণির উপর ভয়াবহ আক্রমণ চালাচ্ছে। এই পুঁজিবাদের শোষণ-শৃঙ্খল থেকে শুধু নিজেদের মুক্ত করাই নয়, সমগ্র মানবসমাজকে মুক্ত করার দায়িত্ব ঐতিহাসিক ভাবে শ্রমিক শ্রেণির উপর ন্যস্ত। এই মহান কর্তব্য সম্পাদনে শ্রমিক শ্রেণিকে সর্বহারা সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে হবে। এটাই বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। এআইইউটিইউসি-র প্রাক্তন সভাপতি সর্বহারার মুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক, মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণে রচিত সঙ্গীত এবং আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।