প্রিয় কমরেড,
দলের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কমরেড কিছু দিন আগে আমাকে অনুরোধ করেন তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে আমি যেন দলের কমরেডদের উদ্দেশে একটি লিখিত আবেদন জানাই৷ ওই নেতৃস্থানীয় কমরেডরা মনে করেন এই পার্টি কংগ্রেসের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা অংশের কমরেডরা যথেষ্ট পরিষ্কার নন৷ তাঁদের সেই আবেদনে সাড়া দিতে আমি অবশ্য দেরি করেছি এবং ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যক কমরেড ও ইউনিট পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতিতে সামিল হয়েছেন৷ তবুও, ওই নেতৃত্বস্থানীয় কমরেডদের অনুভূতি ও মতামতকে বিবেচনা করে আমি কিছু বক্তব্য রাখব বলে ঠিক করেছি৷ নিম্নোক্ত কারণগুলি আমি সংক্ষেপে রাখতে চাই:
১) যদিও দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের পরে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পরিস্থিতিতে কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, তাই বিগত পার্টি কংগ্রেসে যে মূল লাইন গৃহীত হয়েছে সেটিই মূলত এখনও বলবৎ রয়েছে, কিন্তু ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বিশেষ ঘটনাবলি দেখা গেছে যেগুলি নিয়ে দলের শিক্ষা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে সর্বস্তরে গভীর আলোচনা এবং মত বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা আছে যাতে শেষ পর্যন্ত পার্টি কংগ্রেসে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার–বিবেচনার পর সর্বসম্মত একটি উপলব্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব হয় এবং সর্বশেষ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার উপযোগী করে পার্টি থিসিসকে উন্নত করা যায়৷
২) শোষণ এবং দমনমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও তার সেবাদাস শাসক সংসদীয় দলগুলির কারণে ভারতবর্ষ এক গভীর এবং ক্রমবর্ধমান আর্থিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটে নিমজ্জিত৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই বেকারত্বের দুঃসহ জ্বালায় ভুগছে, পুনরায় হাজার হাজার শ্রমিক–কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে, প্রতিদিন শিশু–কিশোরী সহ হাজার হাজার নারীকে দেহব্যবসার বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে৷ প্রতি মিনিটে শিশু, বৃদ্ধা সমেত শত শত মহিলা ধর্ষিতা, গণধর্ষিতা হচ্ছে, খুন হচ্ছে৷ ধারাবাহিকভাবে মূল্যবৃদ্ধি, করবৃদ্ধি হচ্ছে, দুর্নীতি বাড়ছে, জনগণের অর্থ লুট হচ্ছে, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দকে সঙ্কুচিত করে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করা হচ্ছে৷ হিন্দু ধর্মীয় মৌলবাদ, অলৌকিকতাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, জাতিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত ঘৃণা ও দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানো হচ্ছে, শিক্ষার গেরুয়াকরণ হচ্ছে যাতে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজিত করে ভোট–ব্যাংক তৈরি করা যায় এবং দেশে ফ্যাসিবাদের প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করা যায়৷ সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তাকেও চুরমার করা হচ্ছে, অর্থ–বাহুবল–প্রচারমাধ্যম-প্রশাসনিক ক্ষমতার দ্বারা নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হচ্ছে, সর্বোপরি নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত নৈতিকতা মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করার দ্বারা দেশের ছাত্র–যুবকদের মনুষ্যত্ববর্জিত করা হচ্ছে৷ এসবের পরিণামে সমগ্র দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে৷ এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির আনুকূল্য লাভ করে তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজারের দায়িত্ব লাভের জন্য দু’টি জাতীয় বুর্জোয়া দল বিজেপি ও কংগ্রেস এবং রাজ্যে রাজ্যে অন্যান্য আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলি পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে৷ সরকারি ক্ষমতায় অথবা বিরোধী আসনেই থাকুক, সর্বদা শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির সেবা করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য৷ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা মালিক শ্রেণিকে সন্তুষ্ট করতে প্রত্যক্ষভাবে পুঁজিবাদী শোষণ অব্যাহত রাখার পক্ষে কাজ করে, প্রতিবাদের সকল কণ্ঠকে স্তব্ধ করে, মানুষের সকল প্রতিবাদকে নির্মমভাবে দমন করে৷ আবার যখন বিরোধী আসনে থাকে তখন জনগণকে ধোঁকা দিয়ে নির্বাচনী জয়ের জমি তৈরি করতে মানুষের দুঃখ–দুর্দশা নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে৷ কিন্তু এতসব সত্ত্বেও মানুষকে চুপ করানো যাচ্ছে না, জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি তাদের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে বাধ্য করছে৷ চাষি, মজুর, ছাত্রছাত্রী এবং শ্রমজীবী মানুষের অন্যান্য অংশের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ, ক্রোধ, প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত, অসংগঠিত, রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বিক্ষিপ্ত গণবিক্ষোভ রূপে এমনকী লাঠি–গুলি উপেক্ষা করে ফেটে পড়ছে৷ কিন্তু সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতির ফলে এই আন্দোলনগুলি মাঝে মাঝেই মাথা তুলছে আবার থিতিয়ে যাচ্ছে৷ একথা পরিষ্কার যে পরিচিত বড় বামপন্থী দল সিপিআইএম এবং সিপিআই তাদের সোস্যাল ডেমোক্রেটিক চরিত্র অনুযায়ীই মাঝে মাঝে আন্দোলনের ভান করা ছাড়া জঙ্গি গণসংগ্রামের পথ ইতিমধ্যেই পরিত্যাগ করেছে৷ বস্তুত তারা ছদ্ম সেকুলার কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটের ধামা ধরে নির্বাচনী সুবিধা গুছিয়ে নিতে চাইছে৷ এ সত্ত্বেও, আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে ঐক্য–সংগ্রাম–ঐক্যের নীতির ভিত্তিতে তাদেরকে যত দূর সম্ভব যুক্ত আন্দোলনে বেঁধে রাখা যাতে আন্দোলনে তাদের ব্যবহার করার পাশাপাশি তাদের আসল চরিত্রকে উদঘাটিত করে দিয়ে তাদের ভূমিকা নিঃশেষ করা যায়৷
কিন্তু বর্তমান সময়ের অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন হল মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ভারতের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদী দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)–কে আরও শক্তিশালী করা, তার বিস্তার ঘটানো এবং সংহত করা যাতে দল এই গণআন্দোলনগুলিকে যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেগুলিকে যথার্থভাবে আদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে৷ এই স্তর অর্জন করার জন্য একান্ত প্রয়োজন দলের অভ্যন্তরে কমরেড শিবদাস ঘোষ নির্দেশিত বৈপ্লবিক শিক্ষানুযায়ী এক প্রবল সংগ্রাম পরিচালনা করা৷ সকল কমরেডদের এই দলীয় অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে নিয়োজিত করার আয়োজন রূপেই এই পার্র্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷
৩) লক্ষণীয় যে বিশ্ব পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদ এক নজিরহীন এবং ক্রমাগত গভীর থেকে গভীরতর সংকটে নিমজ্জিত হয়ে ছটফট করছে৷ শক্তিশালী সমান্তরাল বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বাজারের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধারাবাহিক বাজার সংকোচনের সংকটে ভুগছে৷ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর যে আমেরিকা নিজেকে একমেরু বিশ্বের ‘প্রভু’ বলে ঘোষণা করেছিল, আজ তাকে চ্যালেঞ্জ করছে একদিকে পুঁজিবাদী দেশে রূপান্তরিত চীন, রাশিয়া এবং অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান৷ এরা একে অপরের বাজার দখলের জন্য পরস্পরের গলা কাটার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে৷ যে আমেরিকাকে একসময় বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির ইঞ্জিন মনে করা হত, আজ সেই দেশ প্রায় একটি ডুবন্ত নৌকায় পরিণত হয়েছে৷ অন্য দেশের বাজার দখল করতে তারাই একদা বিশ্বায়ন পরিকল্পনার অগ্রদূত ছিল, আজ সেই পরিকল্পনাকেই ব্যবহার করে যখন অপর প্রতিযোগী দেশগুলি মার্কিন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার গ্রাস করছে তখন তারা বাধ্য হচ্ছে বিশ্বায়নের স্লোগান পাল্টে ‘আমেরিকার স্বার্থই সর্বাগ্রে’ এই স্লোগান তুলতে এবং শুল্কের প্রাচীরকে আরও কঠোর করতে যার বিরুদ্ধে চীন ও অন্যান্য দেশগুলি প্রতিশোধাত্মক ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ এই পথে বিশ্বব্যাপী এক বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে৷ এই বাণিজ্যযুদ্ধের পরিণতি কী শেষপর্যন্ত ঘটবে তা একটা বড় প্রশ্ন, যার উত্তর ভবিষ্যতই দেবে৷ অন্য দিকে এই সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি ধারাবাহিক মন্দা, ক্লোজার, ছাঁটাই, বেকারি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক গভীর সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে যেগুলি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে৷ ফলে জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে যার পরিণতিতে শ্রমিক ধর্মঘট, ছাত্র ধর্মঘট, গণআন্দোলন ঢেউয়ের মতো বারবার আছড়ে পড়ছে৷ ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, ‘আরব বসন্তের’ মতো আন্দোলন বারবার গমকে গমকে ফেটে পড়বে, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী নেতৃত্বের অভাবে সেই আন্দোলনগুলি আবার ভাটায় স্তিমিত হয়ে যাবে৷
একথা কমরেডরা জানেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ এবং চীনে প্রতিবিপ্লবের ফলে সেই সব দেশেই শুধু সমাজতন্ত্র ধ্বংস হয়নি, তদানীন্তন বিশ্বে শক্তিশালী সাম্যবাদী আন্দোলনেরও বিরাট বিপর্যয় ঘটেছে৷ বহু কাল আগেই কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন যে, সোভিয়েত এবং চীন নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অন্ধ আনুগত্য এবং নিজেদের আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক নিচু মানের জন্য তারা আধুনিক সংশোধনবাদের বিপদ এবং প্রতিবিপ্লবের কারণগুলি বুঝতে পারেনি৷ ফলে যখন সোভিয়েত সমাজতন্ত্র উৎখাত হয়ে গেল এই কমিউনিস্ট পার্টিগুলি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল এবং আদর্শগতভাবে দেউলিয়া, হতাশ, নিষ্ক্রিয় এবং শেষপর্যন্ত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল৷ বর্তমানে প্রায় সকল দেশে নিজেদের কমিউনিস্ট বলে দাবি করে এমন বহু গোষ্ঠী ও দল আছে, কিন্তু অধিকাংশেরই বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সুনির্দ্দিষ্ট মার্কসবাদী–লেনিনবদী উপলব্ধি না থাকার ফলে তারা আদর্শগত বিভ্রান্তিতে ভুগছে৷ কেবলমাত্র আমাদের দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) কমরেড শিবদাস ঘোষ কর্তৃক উন্নত মার্কসবাদী উপলব্ধির দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে এবং একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের লেনিনীয় পদ্ধতির উন্নত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই সংকটকে সঠিকভাবে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পেরেছে৷ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের ভিতরে ধূমায়িত বিপদ সম্পর্কে তিনি আমাদের পূর্বাহ্ণেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য আদর্শগত হাতিয়ারও দিয়ে গেছেন৷ তাঁর অমূল্য শিক্ষাকে অনুসরণ করে আমাদের দল এই সংকটে অবিচল থেকেছে শুধু তাই নয়, মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা এবং সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে আমাদের দল ক্রমাগত বিকশিত ও বিস্তৃত হচ্ছে৷
স্মরণ করা যেতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মহান এঙ্গেলসের হাতে গড়া দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অধঃপতিত হয়ে পড়ে এবং মার্কসবাদের প্রাণসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে সংশোধনবাদে নিমজ্জিত হয়৷ সেই সংকটের সময় মহান লেনিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সংশোধনবাদী নেতৃত্বকে আদর্শগতভাবে পরাস্ত করেন এবং মার্কসবাদের প্রাণসত্তাকে রক্ষা করেন ও তার মধ্য দিয়ে পঁুজিবাদের নতুন স্তরে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে মার্কসবাদের উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান, যাকে লেনিনবাদ আখ্যা দিয়ে মহান স্ট্যালিন ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ’ বলে অভিহিত করেন৷ একে সঠিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয় যার পথ ধরে চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব সফল হয়৷ কিন্তু সমাজতন্ত্রের বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও পরবর্তী কালে আধুনিক সংশোধনবাদ কুৎসিত মাথা তোলে এবং শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া প্রতিবিপ্লব সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে৷
এখন বর্তমান পরিস্থিতির জরুরি প্রয়োজন হল, বিভিন্ন দেশে পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, বিকাশ ও শক্তি অর্জন করা যাতে দেশে দেশে চলমান শ্রেণিসংগ্রাম ও গণআন্দোলনেতারা নেতৃত্ব দিতে পারে৷ আমরা মনে করি, এই সংকটময় সময়ে দেশে দেশে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতে ও বিকাশলাভ করতে পারে কেবলমাত্র মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার সঠিক উপলব্ধি ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে৷ মার্কসবাদের এই উন্নত উপলব্ধিকে অন্য দেশের সর্বহারা শ্রেণির কাছে পৌঁছে দেওয়া, প্রচার করা আমাদের দলের আবশ্যিক আন্তর্জাতিক দায়িত্ব৷ এই ঐতিহাসিক কর্তব্য সমাপন করতে হলে আমাদের দলকে আদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও নৈতিকভাবে আরও উন্নত ও সংহত হতে হবে৷ পার্টি কংগ্রেস সেই কর্তব্যের প্রারম্ভিক ধাপ৷
৪) অতীতে, বিশেষ করে আমাদের দলের গঠনের সময়ে এবং তার পরেও কয়েক দশক ধরে দলের বিস্তারে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হতে হয়, কারণ অবিভক্ত সিপিআই এবং পরে সিপিআইএমকে তাদের লড়াকু ভাবমূর্তির জন্য এবং তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সমর্থনের কারণে মানুষ তাদের প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি বলে মনে করত৷ এই সংকটকাল অতিক্রম করতে কমরেড শিবদাস ঘোষকে এক দৃষ্টান্তমূলক কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল৷ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণই আলাদা৷ সিপিআইএম–এর স্বরূপ অনেকটাই উদঘাটিত৷ সে তার আগের লড়াকু ভাব হারিয়েছে, আর শাসক শ্রেণির আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নির্বাচনী সুবিধা লাভের জন্য কখনও এই, কখনও ওই বুর্জোয়া জোটের সঙ্গে দহরম মহরম করছে৷ তারা আদর্শগতভাবে দেউলিয়া হয়েও পড়েছে৷ জনগণের সামনে নিজেদের ভাবমূর্তি তারা যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ করেছে৷ সিপিআই দল আজ সিপিআইএমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেবলমাত্র বয়স্ক মানুষদের একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে৷ উভয় দলই অবক্ষয়ের পথে চলেছে৷ সুতরাং এই সময়টা আমাদের দলের দ্রুত বৃদ্ধির পক্ষে খুবই উপযুক্ত৷ খুবই আশার কথা, যে–সমস্ত রাজ্যে ও জায়গায় কমরেড শিবদাস ঘোষ ও আমাদের দলকে এখনও মানুষ জানে না, সেখানেও এমনকী যদি অপরিণত কর্মীরাও কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে বহন করে নিয়ে যায়, তারা সৎ বামমনস্ক মানুষ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুব, শ্রমিক, কৃষকদের কাছ থেকে উৎসাহজনক সাড়া পায়৷ এই অনুকূল পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যে একটা ভাল সংখ্যক যুব ও ছাত্র কর্মীদের বাছাই করে প্রশিক্ষিত ও উন্নত করা যাতে তারা নতুন নতুন অঞ্চলে সংগঠন গড়ে তুলতে পারে৷ এই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজটি তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি কর্মের মধ্যে যুক্ত হয়ে আছে৷
৫) বর্তমান আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি আমাদের মতো প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে খুবই সংকটময়৷ একসময়ের শক্তিশালী বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন এবং বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সর্বত্র হতাশা সৃষ্টি হয়েছে৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ, সাম্যবাদী মতাদর্শকে ক্রমাগত আক্রমণ ও নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে৷ একদা যে মার্কসবাদী চিন্তানায়কদের মানুষ গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখত, আজ তাদের ক্রমাগত হেয় করার অপচেষ্টা হচ্ছে৷ সমাজের মধ্যে আজও যতটুকু যুক্তিবোধ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ রয়েছে তাকেও ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে৷ এই সময়ে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ, সাম্যবাদের মহত্ত্বকে রক্ষা করা এবং ঊর্ধ্বে তুলে ধরা খুবই জরুরি, যদিও কাজটা অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টসাধ্য৷ কিন্তু ইতিহাস আমাদের উপর এই কঠিন কাজের দায়িত্বই অর্পণ করেছে৷ এই দায়িত্ব দাবি করে কমরেডদের আদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, নৈতিক মান উন্নত করার জন্য দলের অভ্যন্তরে একটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কঠোর মরণপণ সংগ্রাম চালানো৷
সব কমরেডই অধঃপতিত পুঁজিবাদের জন্মচিহ্ণ নিয়েই দলে যোগ দেন৷ পুঁজিবাদের দূষিত পরিবেশ আমাদের সকলকে ঘিরে আছে, যা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আমাদের মধ্যে প্রভাব ফেলছে, ক্ষতিকারক আক্রমণ করছে৷ এর প্রভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে ব্যক্তিবাদ, অহংবোধ, আত্মপ্রচার, সমালোচকদের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব, পদের আকাঙক্ষা, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, কর্তব্য ও নিয়ম–শৃঙ্খলার প্রতি অবহেলা, দলের মধ্যে কেন্দ্রিকতা ও অথরিটিকে অমান্য করে নিজের মতো চলার ঝোঁক, আরাম–আয়েসের জীবন, ভোগবাদের প্রতি আকর্ষণ, প্রেম–ভালবাসা–যৌনতা প্রশ্নে অনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবারের প্রতি দুর্বলতা ইত্যাদি ঝোঁক দেখা দেয়৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে হাতিয়ার করে আমরা যদি সদাসর্বদা সতর্ক না থাকি এবং সংগ্রাম না চালাই তবে আমরাও এই সব বুর্জোয়া ব্যাধির শিকার হয়ে যেতে পারি৷ আমরা ভুলে যেতে পারি না মুমূর্ষু পুঁজিবাদের বর্তমান সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের স্তরে পুঁজিবাদের সকল প্রকাশ্য ও গুপ্ত আক্রমণকে প্রতিহত করে কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জন করা ও তাকে রক্ষা করা খুবই কঠিন সংগ্রাম৷ এমনকী এক মুহূর্তের অসতর্কতা, ঢিলেমি অথবা আপস একদা অর্জিত উন্নত চরিত্রেরও পতন ঘটাতে পারে৷ সুতরাং কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোকে যৌনতা সহ জীবনের সর্ব দিককে ব্যাপ্ত করে নিরন্তর সংগ্রাম পরিচালনা করা অবশ্য প্রয়োজনীয়৷ এই সংগ্রাম পরিচালনা করা এবং দলীয় সংগঠনের ডঁচু থেকে নিচু তলা পর্যন্ত পুনরুজ্জীবন ঘটানো একটি জরুরি কর্তব্য৷ ইতিমধ্যে রোগ, বার্ধক্য এবং শত্রুর আক্রমণে বহু মূল্যবান তরুণ ও প্রবীণ কমরেডকে দল হারিয়েছে৷ সংগঠনের স্তরে স্তরে অনেক নেতারা বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত, শারীরিকভাবে অশক্ত হয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ আপসমুখীনতা ও উদ্যোগহীনতায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ এই পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন প্রাণচঞ্চল, যোগ্য, কর্মক্ষম কমরেডদের এগিয়ে এনে সর্বস্তরের পার্টি বডিগুলির পুনর্গঠন করা৷ এই কর্তব্য সুসম্পন্ন করা আসন্ন তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের অন্যতম লক্ষ্য৷
আমি আশা করি এই পরিপ্রেক্ষিত এবং আমাদের কর্তব্যের সঠিক উপলব্ধির ভিত্তিতে সর্বস্তরের পার্টি কমরেডরা এগিয়ে আসবেন এবং তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসকে সফল করবেন৷
(৭১ বর্ষ ১ সংখ্যা ৩ আগস্ট, ২০১৮)