প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের স্কুল পড়ুয়াদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত! ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাকি অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগছে। তাই তিনি পড়ুয়াদের মিড ডে মিলে তেলের পরিমাণ কমাতে বলেছেন। তেলের ব্যবহার কমাতে সেঁকা (গ্রিলড), সেদ্ধ খাবারের উপদেশও দিয়েছেন। সাথে সাথে তাঁর অনুগত শিক্ষামন্ত্রক ফরমান জারি করেছে, মিড ডে মিলে ভোজ্য তেলের পরিমাণ দশ শতাংশ কমাতে হবে।
শুনলে আচর্য হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী সত্যি এ দেশেরই মানুষ তো? ওজন বাড়ার সমস্যা মূলত যেখানে, সেই উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোটদের জীবনযাত্রার সাথে দেশের শহরে-গ্রামে হাজার হাজার সরকারি স্কুলে পড়তে আসা পড়ুয়াদের জীবনের যে আসমান-জমিন ফারাক, এ কি তিনি সত্যিই জানেন না? এমনিতেও ছোটদের ওজন বাড়লে তা কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা ব্যায়াম, জাঙ্ক ফুড খাওয়া কমানোর কথা বলেন। অন্য খাদ্য উপাদানের মতোই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে তেলও ছোটদের খাবারে থাকা প্রয়োজন। আর যে শিশুদের ওজন বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত বাড়ছে, তাদের বেশিরভাগই যে সরকারি স্কুলের মিড ডে মিলের ওপর নির্ভরশীল নয়, এটাও জানা কথা। তাহলে হঠাৎ সব ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী মিড ডে মিল রান্নায় তেল নিয়ে পড়লেন কেন?
কী থাকে মিড ডে মিলে? ট্যালটেলে ডাল, একটু আলুমাখা, গরম পড়লে যা থেকে প্রায়ই ভ্যাপসা গন্ধ বেরোয়। কোনও কোনও দিন সয়াবিনের বিস্বাদ ঝোল বা জলের মতো ঘুগনি আর সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন ডিমসেদ্ধ। এ রাজ্যে সম্প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ডিম দেওয়ার কথা বলা হলেও সর্বত্র তা জুটছে কিনা, জুটলেও কতদিন জুটবে সরকারি কর্তারাই বলতে পারবেন। কারা খায় মিড ডে মিল? বহু ঢাকঢোল বাজিয়ে এই প্রকল্প ঘোষণা হয়েছিল তাদের জন্য, বাড়িতে যাদের পুষ্টিকর খাবার জোটে না– সেই সব দরিদ্র, নাচার পরিবারের ছেলেমেয়েরা যাতে পেটভরা খাবারের টানে অন্তত স্কুলমুখী হয় এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়, এই ছিল ঘোষিত উদ্দেশ্য। দেশের অধিকাংশ সরকারি স্কুলে এই অতি-দরিদ্র, দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই আজও মিড ডে মিলের লাইনে দাঁড়ায় থালা-বাটি হাতে। একটা গোটা ডিম পেলে মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আবার কখনও কখনও বকুনি খায় মিড ডে মিলের ভাত ফেলে-ছড়িয়ে খাওয়ার জন্য।
বকতে গিয়ে শিক্ষকদেরও থমকে যেতে হয়, কারণ ছোটদের সত্যিই পুষ্টি এবং পেট ভরে খাওয়ার আনন্দ দিতে গেলে খাবারের যেটুকু গুণমান থাকা প্রয়োজন, এই খাবারে তা যে নেই সে কথা তাঁরাও জানেন। থাকার উপায়ও নেই, কারণ এই মুহূর্তে প্রাথমিক স্তরে মাথা পিছু বরাদ্দ ৬ টাকা ১৯ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৯ টাকা ২৯ পয়সা। বাজার চলতি তেলের দামের সাথে এই বরাদ্দ তুলনা করলেই বোঝা যায়, পড়ুয়াদের পাতে তেল এমনিতেই নামমাত্র। অগ্নিমূল্য বাজারে এই বিন্দুবৎ বরাদ্দে যে শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ হতে পারে না, এ কথা বোঝাও কঠিন নয়। সুতরাং মিড ডে মিলের মেনুতে যতই হিসেব কষে ডাল, প্রোটিন ইত্যাদির কথা বলা হোক, প্রয়োজনের জায়গায় এই প্রকল্প এখন যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারগুলোর দয়ার দান। বাজেটের পর বাজেট আসে। মন্ত্রী, সাংসদদের বেতন বাডে, সামরিক খাতে খরচ বাডে, শিল্পপতিদের জন্য কর ছাড়ের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু পেট ভরে খাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা ওই কচিমুখগুলোর পাতে বরাদ্দ বাড়ে না, বাড়ে না মিড ডে মিল কর্মীদের যৎসামান্য বেতন। সমালোচনা হলে কেন্দ্র, রাজ্য পরস্পরকে দোষারোপ করে দায়িত্ব সারে।
প্রধানমন্ত্রী অতিরিক্ত ওজনের তথ্য দেখানোর সময় ভুলে গেছেন, অন্য তথ্যও আছে। সে তথ্য বলছে, বিশ্বের অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের ৬৫ শতাংশ আছে ভারতে, অপুষ্ট শিশুর সংখ্যার নিরিখে এশিয়ায় তিন নম্বরে আছে আমাদের দেশ। এই যখন অবস্থা, তখন মিড ডে মিলে বরাদ্দ বাড়ানো এবং পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার বদলে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে মিড ডে মিলে আরও তেল কমানোর উপদেশ মনে করিয়ে দেয় ফ্রান্সের রানির সেই কদর্য উক্তি– ‘ওরা রুটি খেতে না পেলে কেক খায় না কেন’?
যে মেয়েটি স্কুলের ফি দিতে না পেরে চিরকালের মতো শিক্ষার পরিসর থেকে সরে যায়, যে ছেলেটি স্কুল ছেড়ে পরিবারের ভাত জোটাতে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিনরাজ্যে শ্রম দিতে যায়, সংসারের ভার একটু কমাতে যে নাবালিকাকে মা-বাবা স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন, মিড ডে মিল তাদেরই প্রয়োজন। আর তাদের জন্য এই ছ-সাত টাকা ভিক্ষার বরাদ্দ রেখে ‘গ্রিলড’ খাবারের উল্লেখ করাও জঘন্য অপরাধ।
এই অপরাধটি নরেন্দ্র মোদি নিছক অজ্ঞতা থেকে করে ফেললেন, এমন ভাবলে বিরাট ভুল হবে। আসলে মুখে যাই বলুন, তিনি এবং তাঁর দল যে গত দশ বছরে মানুষের জীবনের মৌলিক কোনও সমস্যারই সমাধান করতে পারেননি, তা নিজেরা ভাল করেই জানেন। বেকারি, দারিদ্র, অশিক্ষা, অপুষ্টি, নারী নির্যাতন– সমাজকে ছেয়ে ফেলেছে, দেশের মানুষের মনে জমা হচ্ছে ক্ষোভের পাহাড়। সেই ক্ষোভ চাপা দিতে রুজি-রুটির সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর জন্য কখনও কুৎসিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, কখনও এরকম সস্তা চমকই তাদের শেষ অস্ত্র।
বছর দুই আগে মিড ডে মিল প্রকল্পের গালভরা নাম রাখা হয়েছিল ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ’। মোদিজির এই অসংবেদনশীল মন্তব্য প্রমাণ করল, বিজেপি সরকারের অন্যান্য বহু প্রকল্পের মতোই প্রধানমন্ত্রীর নামমাহাত্ম্য প্রচারই এর মূল উদ্দেশ্য। দেশের কোটি কোটি অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর জীবনে ওই পোষণ, শক্তি, নির্মাণের মতো শব্দগুলোর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।