যতদূর দেখা যায় মানুষ, শির উঁচু করা মানুষ। উজ্জ্বল এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, শিশু সন্তান কোলে বাবা মা, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গৃহ পরিচারিকা, শ্রমিক-চাষি, আইনজীবী, ডাক্তার, অধ্যাপক সকলে সমস্বরে আওয়াজ তুলছে। যতখানি শোনা যায় সেই হৃদয় নিংড়ানো ধ্বনি– ‘মানি না, মানবো না’। শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও থ্রেট কালচার মানি না, মানবো না। জীবনযন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হতে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে এ সমাজের কাছে নিজেদের দাবিকে সোচ্চার করে তুলছে সহস্র ‘মিছিলের মুখ’। ‘মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর’, ‘কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্যের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে’। দু’পাশে তখন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষারত জনগণের চোখে মু*তা। না, কোনও হইচই নেই, বিরক্তি নেই। নেই মিছিল ভেঙে ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যাবার কোন তাড়াহুড়ো। হেদুয়া থেকে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় অনেকগুলি স্কুল। স্কুল ছুটির সময় বাবা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে শিশু-কিশোররা অবাক চোখে দেখছে। সরকারি শিক্ষা ধ্বংস করার বিরুদ্ধে এই মিছিলকে অস্বীকার করতে পারছেন না অভিভাবকরাও। তাই তাঁদেরও আজ কোন তাড়া নেই। অপেক্ষমান বহু জন নিজস্ব মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করছেন মিছিলকে। মিছিল যত এগোচ্ছে মোড়ে মোড়ে অজস্র মানুষ যুক্ত হয়ে মিছিলের আয়তনকে ততই বাড়িয়ে তুলছে। রাস্তার ধারের দোকানের এক কর্মচারী মহিলা খাওয়া ফেলে উঠে এসেছেন। ‘ন্যায়বিচারের দাবি, চুপ করে বসে থাকি কী করে! আগে মিছিল, পরে খাওয়া।’ কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার-ওয়েলিংটন বিভিন্ন মোড়ে মিছিলের নেতৃত্বকে অভিনন্দিত করছেন জনগণ। কী আচর্য জাদু বলে এমনভাবে আট থেকে আশি, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে শ্রমজীবী মানুষ থেকে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত জন সকলকে এক করে দিল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)? না, কোনও এমএলএ নেই, এমপি নেই। নেই অর্থের বিরাট জোর। কিন্তু আছে অমোঘ শক্তি– সত্যের শক্তি, আদর্শের শক্তি। দেশের মাটিতে যারা সাধারণ মেহনতি মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-ন্যায়বিচার ইত্যাদি সমস্ত অধিকারকে খর্ব করতে চায়, সেই কর্পোরেট হাঙর ও তাদের সেবাদাস কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে সামিল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)। মিছিল দেখে তাই দুই পথচারী নিজেদের আলাপচারিতায় বলেন ‘এরাই পারবে, এদের কোনও সেটিং নেই।’
২১ জানুয়ারি ২০২৫, এ দুনিয়ার বুকে শোষণহীন সমাজের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার কারিগর, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা মহামতী লেনিনের শততম স্মরণ দিবস। এ দিন দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংগ্রামে শপথ নেওয়ার দিন। এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতা দেখিয়ে দিল সেই সংগ্রামী মেজাজ। সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন নয়, বিচার ব্যবস্থার পায়ে হত্যে দেওয়া আর নয়, শেষ কথা বলবে গণআন্দোলনই। মিছিল দেখিয়ে দিল তিলোত্তমার বিচার মামলায় কোর্টের রায় যতই হতাশাব্যঞ্জক হোক, মানুষ হতাশ নন। আস্থা আছে আন্দোলনে। অন্ধকারের অতলে ডুবতে থাকা এ সমাজ ব্যবস্থার প্রাণভোমরা নিহিত আছে জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতেই।