দিল্লির কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল কৃষিজ দ্রব্যের নূ্যনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) আইনসঙ্গত করা ও যথার্থ উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম নিশ্চিত করা। নরেন্দ্র মোদি সরকার আন্দোলনের চাপে এই দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু সেই আশ্বাস তারা পূরণ করেনি। এর ফলে বিগত নির্বাচনে বিজেপি কৃষকদের প্রবল ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে এবং অন্তত ১৫৯টি আসনে কৃষকরা বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু এখানেই কৃষকরা চুপ করে বসে থাকবে না। তারা তাদের দাবি আদায়ের জন্য আবার মরিয়া সংগ্রামে নামতে বদ্ধপরিকর। আবার তারা পথে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই এ আই কে কে এম এস ভারতজুড়ে এমএসপি-র দাবিতে পথে নেমেছে। অন্যান্য কৃষক সংগঠনও পথে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা সংগ্রাম ঘোষণা করেছে। ফলে আতঙ্কিত বিজেপি সরকার কৃষকদের প্রতারিত করার জন্য খরিফ ফসলের সংগ্রহ মূল্য খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে তারস্বরে প্রচার করছে– এই দেখো, আমরা কৃষকদের এমএসপি-র দাবি মেনে নিয়েছি, আমরা উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম দিচ্ছি। ভাবখানা এমন যে, দেখো মোদি সরকার কত কৃষকদরদি!
বিজেপি সরকারের এই দাবি যে কত ভ্রান্ত তা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়।ধানের কথাই ধরা যাক। প্রকৃত উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম যদি দিতে হয় তাহলে ধানের দাম কত ধার্য করতে হবে? কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইসের (সিএসিপি) হিসাব অনুযায়ী, দাম দিতে হবে ৩০১২ টাকা। সরকার দাম ধার্য করেছে কত টাকা? ২৩০০ টাকা। অর্থাৎ ৭১২ টাকা কম। একইভাবে জোয়ার, বাজরা, মুগ ডাল, তুলা ইত্যাদি ফসলের ক্ষেত্রে দাম যথাক্রমে ১০৬৬ টাকা, ২৭৯ টাকা, ২২৭৪ টাকা ও ২২২৪ টাকা কম ধার্য করেছে। অর্থাৎ কৃষকদের বেঁচে থাকার জন্য স্বামীনাথন কমিশন যে সুপারিশ করেছিলেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি যে দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার তুলনায় অনেক কম টাকা ধার্য করা হয়েছে।
আর একটা কথা। টাকার অঙ্কে কিছুটা বাড়িয়ে বিজেপি সরকার তাকেই কৃষক দরদের নমুনা হিসাবে মানুষের সামনে হাজির করছে। কিন্তু সার-বীজ-তেল-বিদ্যুতের দাম যে ওরা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তার ফলে চাষের খরচ যে অনেক বেড়ে গেছে সেই বিষয়টা ধূর্ত বিজেপি নেতারা হিসাবের মধ্যে ধরার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ভেবেছেন কৃষকরা ওদের এই চালাকি ধরতে পারবে না। তা ছাড়া জীবনধারণের অন্যান্য উপকরণের দামও যে রকেটের গতিতে বেড়েছে এ কথা বলাই বাহুল্য। ফলে প্রকৃত আয় বৃদ্ধির কথা যদি আমরা বিবেচনায় রাখি তাহলে কৃষকের আয় বাস্তবে কমেছে। এই বাস্তব অবস্থা একমাত্র গায়ের জোর ছাড়া বিজেপি সরকার কোনও মতেই অস্বীকার করতে পারবে না।
কৃষকদের অভিজ্ঞতা হল, এই সরকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর, আদানি-আম্বানিদের পোষা গোলাম। তাই কৃষকরা যদি লাভজনক দাম পায় এবং জনগণ যদি সস্তা দরে খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরকারি ব্যবস্থাপনায় পায়, অর্থাৎ যদি সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু হয়, তাহলে এই সব হাঙর একচেটিয়া পুঁজিপতিদের খাদ্য-ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তা করার ক্ষমতা কি এই সরকারের নেই?
করতে গেলে সরকারি ক্ষমতায় ওরা একদিনও টিকে থাকতে পারবে না। ফলে জনগণকে প্রতারণা করা ছাড়া ওদের উপায় কী? কিন্তু কৃষকরা এই প্রতারণা মেনে নেবে না। এই প্রতারণার যোগ্য জবাব এই দেশের কৃষকেরা একদিন দেবেই। ইতিমধ্যে সংগ্রামী কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস দিল্লিতে সর্বভারতীয় কৃষক সমাবেশের ডাক দিয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে। এই উপলক্ষে দেশ জুড়ে চলছে ব্যাপক প্রচার।