এমএসপি ঘোষণাই সার চাষির সুরাহা নেই

 

ফাইল চিত্র

৭ জুন কেন্দ্রীয় সরকার ১৭টি খরিফ শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করেছে। কৃষক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি এমএসপি। এই দাবি পূরণে মোদি সরকার বারবার টালবাহানা করে চলেছে। ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছে। কৃষক সমাজের মধ্যে প্রবল বিজেপি বিরোধী বিক্ষোভের আগুন যে ধিকিধিকি করে জ্বলছে, রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপি তা টের পেয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন কয়েক মাস পরেই। ফলে স্রেফ ভোটের কথা মাথায় রেখেই বিজেপি সরকার কৃষক বিক্ষোভ সাময়িকভাবে প্রশমিত করতে এমএসপি কিছুটা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। এই ঘোষণার কয়েক দিন আগে থেকে কুরুক্ষেত্রের পিপলিতে কৃষকরা মহাপঞ্চায়েত করে সূর্যমুখী তেলের এমএসপি কুইন্টাল প্রতি ৬৪০০ টাকায় করার দাবি তুলেছে। এই দাবিতে দিল্লিগামী ৪৪ নং জাতীয় সড়ক তারা অবরোধ করে। হরিয়ানার বিজেপি সরকার এই আন্দোলনে লাঠিচার্জ করে এবং কয়েক জন কৃষক নেতাকে গ্রেপ্তার করে।

এমএসপি কী? এটি হল কৃষকদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য যা কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়ার কথা, কখনও রাজ্য কিছুটা বোনাস মূল্য এর সঙ্গে যুক্ত করে, যাতে কৃষকদের ঘিরে একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়। কেন এই নিরাপত্তা বলয় জরুরি? কারা কৃষকের আর্থিক নিরাপত্তা বিপন্ন করে? কৃষকের নিরাপত্তার সামনে প্রধান বাধা খাদ্যপণ্যের একচেটিয়া বৃহৎ ব্যবসায়ীরা, যারা কৃষিপণ্যের ক্রেতা। এদের কাছে ফসল বিক্রি করা ছাড়া কৃষকের অন্য কোনও পথ নেই। এরা পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী সর্বোচ্চ মুনাফা করতে দাম যতদূর সর্বনিম্ন করা যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই দরকষাকষিতে ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় কৃষক। কারণ ফসল বিক্রির জন্য তার বিকল্প কোনও জায়গা নেই। ব্যবসায়ীদের দয়ার উপর তাদের বাঁচতে হয়। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজারে যখন কৃষিপণ্যের দাম উৎপাদন ব্যয়ের সমান বা তার নিচে নেমে যায়, কৃষক ধ্বংসের কবলে পড়ে। তার বেঁচে থাকাটাই দুঃসহ হয়ে ওঠে। কৃষক স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এইভাবে কৃষকের ভূমিহীন হওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বত্র দেখা যায়।

এই অবস্থায় কৃষকের বাঁচার পথ কী? এই সঙ্কটের সামনে আশু প্রয়োজন হল কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা এবং একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের বিকল্প হিসাবে সরকারিভাবে কেনার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে প্রচণ্ড গাফিলতি। সরকার যে এমএসপি ঘোষণা করেছে তাতে বলা হয়েছে, ১৭টি কৃষিপণ্যে ৫-১০.৫ শতাংশ এমএসপি বাড়বে। গড় বৃদ্ধি ৭ শতাংশ। সিটি রিসার্চ দেখিয়েছে, এই সময়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৬.৮ শতাংশ। তাহলে গড়ে সাত শতাংশ বৃদ্ধি কৃষকদের সঙ্গে মস্ত বড় তামাশা ছাড়া আর কী?

তামাশার দ্বিতীয় পর্বটি চমৎকার। এমএসপি ঘোষণা করলেই সরকার অত্যন্ত তৎপরতার সাথে সেই দামে কিনতে নামে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বৃহৎ ব্যবসায়ীরা কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা করে চাষিদের ঠকিয়ে বিপুল মুনাফা যাতে করতে পারে এবং প্রতিবার ইলেকশনে যাতে এই দলকেই ক্ষমতায় বসায়, সেই লক্ষ্যে সরকার কৃষিপণ্য কেনায় ‘ধীরে চলো’ নীতি নেয় এবং কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহও দেখায় না। আবার কৃষকদের আন্দোলনের চাপে সামান্য যতটুকু বা কেনে সেটা সব রাজ্যে নয়, মুষ্টিমেয় কিছু রাজ্যেই তা সীমাবদ্ধ। ক্রিসিল রিসার্চ রিপোর্ট দেখিয়েছে, ধান, তুলো এবং কিছু ক্ষেত্রে ডাল এমএসপিতে কেনা হয়। ঘোষিত পণ্যগুলির সব কেনা হয় না। ধান, তুলো ও ডালের কতটুকু কেনা হয়? রিপোর্ট বলছে, উৎপাদিত ধানের মাত্র ৪৫ শতাংশ কেনা হয়, তুলো কেনা হয় ২৫ শতাংশ, আর ডাল কেনা হয় ১-৩ শতাংশ। অর্থাৎ ধানের ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ, তুলো ৭৫ শতাংশ এবং ডালের ক্ষেত্রে ৯৭ শতাংশ খোলা বাজারের হাঙরের সামনে ফেলে রাখা হয়েছে। বৃহৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থে এইভাবে সরকার কৃষকদের স্বার্থ বলি দিচ্ছে। তার ঘোষিত এমএসপি কার্যকর করছে না ।

ক্রিসিল রিসার্চ রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে, সামান্য যতটুকু সরকার কেনে সেখানেও রয়েছে প্রাদেশিক বৈষম্য। ধানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ক্রয় মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশে, ছত্তিশগড় এবং তেলেঙ্গানা রাজ্যে সীমাবদ্ধ। তুলো কেনা হয় তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রে। আর ডাল কেনা হয় মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে। বাকি সব রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যদি কিছু কেনাও হয় তা যে নামে মাত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের এই এমএসপি ঘোষণা বাস্তবে চাষি শোষণের সামনে কতটুকু প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে? কৃষক স্বার্থকে গুরুত্ব দিলে সরকারের উচিত ছিল উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সাপেক্ষে যথাযথভাবে এমএসপি ঘোষণা করা এবং সব রাজ্যে তা কার্যকর করা। বাজারে আনা পণ্যের সবটা সরকারি উদ্যোগে কেনার ব্যবস্থা করা। সরকার তা করেনি। এটা শুধু কৃষকের স্বার্থে জরুরি তা নয়, ক্রেতাদের স্বার্থেও জরুরি। তা না হলে কৃষিপণ্যের দাম ব্যবসায়ীরা আরও বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। খাদ্যব্যবসায়ীদের স্বার্থে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার যেমন এই সমস্যার সমাধান করেনি তেমনই বর্তমান বিজেপি সরকারও। রাজ্যে পূর্বতন সিপিএম এবং বর্তমান তৃণমূল সরকার ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই পালন করছে না।

কিন্তু কেন কৃষকদের এমন ভয়ঙ্কর দুরবস্থা দশকের পর দশক চোখের সামনে দেখেও এই দলগুলির সরকার কেউই তা নিরসনের জন্য কোনও চেষ্টা করে না। আসলে শ্রেণিগত ভাবে এই দলগুলির কোনওটিই শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থরক্ষাকারী দল নয়। দল মানেই শ্রেণি দল। এই দলগুলি সকলেই শিল্পক্ষেত্রে যেমন শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে, তেমনই কৃষিক্ষেত্রে বৃহৎ জোতের মালিক এবং খাদ্যপণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে। তাই বিজেপি আদানি-আম্বানিদের মতো দৈত্যাকার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে যেমন কৃষক স্বার্থধ্বংসকারী তিনটি কৃষি আইন নিয়ে এসেছিল, যেমন দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনেও কৃষক অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে, আবার কৃষিনীতির বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলনকে একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের সঙ্গে বসে রফা করে নেওয়ার ‘সুপারিশ’ করেছিলেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। ভোট, সরকার বদল, পঞ্চায়েত দখল ইত্যাদি কোনও কিছুই কৃষক শোষণের এই প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে পারছে না। এটা বন্ধ করতে হলে একটা যথার্থ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন জরুরি।