সন্দেশখালিতে তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের অনুগামী বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিশেষত মহিলাদের বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এলাকার মানুষ বিশেষত মহিলারা বিক্ষোভ শুরু করেন। থানা ঘেরাও করে অত্যাচারী নেতাদের বাড়ি, পোল্ট্রি ফার্মে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, জবর দখল করা ভেড়ি, জায়গা-জমি ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সন্দেশখালির দুটি ব্লকেই। ৮ ফেব্রুয়ারি এস ইউ সি আই (সি) বসিরহাট সাংগঠনিক জেলা সম্পাদক কমরেড অজয় বাইন সহ দলের কর্মীরা থানার সামনে বিক্ষোভরত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। বিক্ষোভ জেলিয়াখালি, খুলনা ইত্যাদি এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়লে দলের নেতৃবৃন্দ গ্রামের ভিতরে গিয়ে এলাকার মহিলাদের সাথে কথা বলেন ও আন্দোলনকে সমর্থন জানান। তাঁরা এলাকার মানুষের কাছে গণকমিটি গড়ে আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী ও সুসংগঠিত করার আহ্বান জানান। ১৩ ফেব্রুয়ারি বসিরহাটের পুলিশ সুপার ও এসডিও-র কাছে স্মারকলিপি দিয়ে দলের পক্ষ থেকে পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকা, শাসক দলের নির্যাতনকারী নেতাদের গ্রেপ্তার, বিক্ষোভকারীদের উপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, অত্যাচার বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রভৃতি দাবি জানানো হয়।
এই বিক্ষোভ সামনে নিয়ে এল এলাকার সর্বময় কর্তা হিসাবে কুখ্যাত শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মারাত্মক অভিযোগকে। গায়ের জোরে জমি দখল, লিজের নাম করে ভেড়ির জন্য জমি নিয়ে টাকা না দেওয়া, নেতাদের জমি বা ভেড়ি কিংবা বাড়িতে কাজ করিয়ে মজুরি না দেওয়া, প্রতিবাদ করলে রাতের অন্ধকারে মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের লোককে তৃণমূলের পার্টি অফিস কিংবা ক্লাবে তুলে এনে অত্যাচার করা, মহিলাদের সাথে অশালীন আচরণ ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে চলছে, অবশেষে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে।
শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আজ উঠছে, মহিলারা যে কথাগুলি সোচ্চারে বলছেন, তার কোনও একটিও পুলিশের অজানা ছিল না। যতদিন না শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিক্ষোভ আছড়ে পড়েছে ততদিন পুলিশ ছিল ভাবলেশহীন দর্শক। বিক্ষোভ ফেটে পড়ার পর পুলিশ কিছুটা সক্রিয়তার ভাব দেখালেও তারা উত্তম সর্দারকে গ্রেপ্তার করার আগে অপেক্ষা করে বসেছিল, কতক্ষণে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে তাকে সাসপেন্ড করার বার্তা আসে! বাকি দুই নেতাকে গ্রেপ্তারের জন্য কার সবুজ সংকেত লাগবে তা পুলিস কর্তারাই বলতে পারবেন। যদিও এলাকার মানুষের অভিযোগ, যে তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ তার এফআইআর-এর ভিত্তিতেই এলাকার বহু সাধারণ মানুষ, বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলের কর্মীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। সিপিএমের এক প্রাক্তন এমএলএও গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সন্দেশখালিতে বর্তমান শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের ছবি অনেকটা যেন সিপিএম আমলে জঙ্গলমহলে দাপুটে সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডে, ডালিম পাণ্ডেদের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের ছবিটাকে মনে করিয়ে দিল আবার। এর আগে দক্ষিণ ২৪ পরগণার মৈপিঠ, উত্তর ২৪ পরগণার সুটিয়াতে সিপিএম-তৃণমূল উভয় আমলেই একই রকম অত্যাচার দেখেছে মানুষ। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে বসার আগে যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বহুদিন আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বর্তমানে আলোচ্য সন্দেশখালি এবং তার কাছাকাছি ভাঙড়, ক্যানিং এলাকাতে সাধারণ মানুষর উপর শাসকদলের দাপট দেখানো, শাসকদলের নেতাদের দখলে একরের পর একর জমি-ভেড়ি, প্রাসাদোপম অট্টালিকার জমানার কি কোনও পরিবর্তন তারা করেছে? সেই একই মুখগুলোর রাজনৈতিক জামার রংটা শুধু বদলেছে। যারা আগের আমলে ছিল সিপিএমের সম্পদ, তাদের অনেকেই তৃণমূলের সম্পদ হয়েছেন, মন্ত্রী কিংবা জেলাপরিষদ, পঞ্চায়েতে সমিতির মাথাও হয়েছেন একই কায়দায়। রাজ্যের অন্যান্য জায়গাতেও এই ধরনের ‘সম্পদ’দের দল পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনও পরিবর্তন তৃণমূল ঘটায়নি। ভোটবাজ শাসকদলগুলির চরিত্রই তাই।
এ রাজ্যের মানুষের ভোলার কথা নয়, ১৯৭৭-এর আগে রাজ্যের নানা অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ানো কংগ্রেসি মস্তানরা কয়েক বছরের মধ্যে কী ভাবে শিবির বদল করে সিপিএম হয়ে গিয়েছিল। এখন তাদের উত্তরসূরীরা আরও পরিণত হয়েছে। ফলে তাদের আর বেশি সময় লাগছে না, ক্ষমতা বদলের গন্ধ পেলেই তারা রঙ বদল করে ফেলছে। এ ব্যাপারে বিজেপিও কম দড় নয়। তারাও কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ও টাকার জোরে বেশ কিছু বাহুবলী ‘সম্পদ’কে কিনেছে। বাস্তবে, সারদা, নারদা মামলায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের নিজেদের দলের নেতৃত্বে বসিয়ে ‘সম্পদে’ পরিণত করতে বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গে যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, চক্ষুলজ্জার বালাইটাও একেবারে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন, তাতে তাদের চরিত্রও বুঝতে মানুষের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আজ সন্দেশখালির ঘটনায় সাধারণ মানুষের উপর শাসকদলের মস্তান ও নেতাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের এই প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি এবং সমর্থনযোগ্য। একই সঙ্গে একটা বিষয় তাঁদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করব, জনসাধারণের স্বার্থবাহী সঠিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ঘটাতে না পারলে বারে বারে স্বতঃস্ফূর্ত জনবিক্ষোভ ভোট রাজনীতির চোরাগলিতেই হারিয়ে যায় কি? এই রাজ্যে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, যতদিন সামগ্রিকভাবে এলাকার জনসাধারণকে নিয়ে গড়ে তোলা গণকমিটির ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, ততদিন শাসকের শত অত্যাচারও মানুষের মাথা নোয়াতে পারেনি। কিন্তু যখনই সেই গণকমিটিকে দুর্বল করে বর্তমান শাসকদল তার সংকীর্ণ নির্বাচনী স্বার্থে মানুষকে ব্যবহার করতে চেয়েছে, মানুষের আন্দোলন দুর্বল হয়েছে, তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে বারবার গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে এই গণকমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে এসইউসিআই(সি)। সন্দেশখালির জনগণকেও ভাবতে হবে বর্তমান রাজ্য সরকারি দলের দাপট, দুর্নীতি, মস্তানিকে রুখতে জনগণ যদি ভেবে নেন এদের বদলে এদেরই প্রতিপক্ষ যে কোনও আর একটা দলকে বসিয়ে দিলে, নিজেদের দায়িত্ব শেষ, তবে জনগণের আবার সর্বনাশ হবে। তৃণমূলের আজকের মস্তানদের রুখতে হলে, এমনকি ভোটেও সরকার বদলের কথা ভাবতে হলে জনস্বার্থকে সামনে রেখে গণকমিটির ভিত্তিতে আন্দোলনের পথেই মানুষের সংগঠিত শক্তি অর্জন করতে হবে। না হলে আরও অনেক এই রকম শাহজাহান, উত্তম, শিবু হাজরারা সুবিধা মতো আর একটি দলে নাম লিখিয়ে একই কাজ চালিয়ে যাবে। আবার হয়ত ক্ষোভে ফেটে পড়বে মানুষ, তার সুযোগ নেবে আর একটা একই রকম নীতিহীন ক্ষমতালোভী দল! এটাই কি চলতে দেব আমরা?