একটি মালয়ালাম চ্যানেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিতে গিয়ে ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, সরকারের নিন্দা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়৷ সরকারের নীতির সমালোচনা করলেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলা যাবে না৷ জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তোলা ঠিক নয়৷
অথচ, ঠিক পরের দিন ৬ এপ্রিল, সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণাকে বুডো আঙুল দেখিয়ে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তথ্যপ্রযুক্তি ও সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে নয়া সংশোধনী এনে এক বিধি প্রবর্তন করে৷ একে বলা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি মধ্যস্থতাকারী নীতি–নির্দেশিকা এবং ডিজিটাল এথিক্স কোড, সংশোধনী–২০২৩, অর্থাৎ আইটি রুলস৷ বলা হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জাল, প্রতারণামূলক সংবাদ, ভুল তথ্য, ফেক ভিডিও, ছবি এবং যে সব প্রোগ্রাম কেন্দ্রীয় সরকারের ‘কার্যাবলি সম্পর্কে ভ্রান্তি সৃষ্টি করে’ তা পরিবেশনা ও সম্প্রচারের প্রক্রিয়া তথা সিস্টেমকে নির্মূল করা এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য৷ ২০০০ সালে পাশ হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় আইটি রুলস ২০২১ এর উপরে এসেছে এই নয়া সংশোধনী৷ কেন্দ্রের ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রককে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ‘ফ্যাক্ট চেক ইউনিট’ বা তথ্য যাচাই বিভাগ গঠন করে এই আইন প্রয়োগের৷ খবর, তথ্য, নিবন্ধ, মেসেজ, ছবি, ভিডিও ইত্যাদির কোনগুলি সরকারের ভাবনার পরিপন্থী, অথবা সরকারের মতে ‘ফেক নিউজ’ এ সব ঠিক করে দেবে এবং সেই মতো ব্যবস্থা নেবে এই বিভাগ৷ অর্থাৎ খবরের কোনটি সত্য আর কোনটি ভুয়ো– তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা পুরোটাই থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷ তার মানে, কোনও সরকারি নীতি অন্যায্য বা অগণতান্ত্রিক হলে তার সমালোচনা করার অধিকার সংবাদমাধ্যমের যতটুকু ছিল, এই সংশোধনী চালু হওয়ার পর ততটুকুও থকবে না৷
মনে পড়ে যায় জার্মানিতে হিটলারের চালু করা ১৯৩৩–এর প্রেস আইনের কথা৷ সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ উইলিয়াম শিরার ‘দি রাইজ অ্যান্ড ফল অব দি থার্ড রাইখ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, প্রতিদিন জার্মানির প্রচার সচিব গোয়েবলসের দপ্তরে সব দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের জমায়েত হয়ে নির্দেশ গ্রহণ করতে হত৷ এই ভারতেও কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার সময় সেন্সরশিপ চেপেছিল সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে৷ বহু সাংবাদিক, সম্পাদককে জেলবন্দি থাকতে হয়েছিল৷ বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাঝে মাঝে মহাসমারোহে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন বটে, কিন্তু তাঁর সরকার যে আইন আনল, তা জরুরি অবস্থার থেকে কম ভয়ঙ্কর নয়৷ এই জমানাতে সরকারের বিরুদ্ধতা করলেই দেশদ্রোহী তকমা জুটছে৷ বহু সাংবাদিক জেল খাটছেন বা মামলার সম্মুখীন৷
ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল ১৯(১)এ, দেশের প্রতিটি নাগরিককে ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে৷ আর্টিকেল ১৯(২)–এ বলা হয়েছে, দেশের সার্বভৌমত্ব, সংহতি, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আদালত অবমাননা, বৈদেশিক সম্পর্কে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কাজ অপরাধ বলে বিবেচিত হবে৷ কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সরকারকে বিচারকের ভূমিকা দেওয়া হয়নি৷ বস্তুত বিভ্রান্তিকর বা ফেক নিউজ ও ভিডিও এখন এ দেশে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে থাকে বিজেপির আইটি সেল৷ তাদের ঘনিষ্ঠরাই মিথ্যা প্রচার ও বিদ্বেষ–ভাষণ দিয়ে বেড়ান৷ এদিকে সেটাকেই অজুহাত করে সংবাদমাধ্যম ও মানুষের বাক স্বাধীনতা কেডে নেওয়ার আইন আনল বিজেপি৷
আগেকার সকল বিধিবাতিল করে, তথ্যপ্রযুক্তি মধ্যস্থতাকারী নীতি নির্দেশিকা এবং ডিজিটাল মিডিয়া এথিক্স কোড–২০২১ যখন চালু হয় তখনই বিতর্ক ওঠে, প্রতিবাদ ওঠে দেশ জুড়ে৷ প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার কর্ণপাত করেননি৷ ওই রুলসকে ভাগ করা হয়েছিল দুই অংশে, কেন্দ্রীয় ইলেট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক সেই বিধি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবে৷ নেটফ্লিক্স, আমাজন ইত্যাদির মতো ‘ওভার দি টপ’ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্ম এবং সমস্ত ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমগুলির মধ্যস্থতার ভূমিকায় থাকবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক৷ নয়া সংশোধনীর আওতায় আনা হয়েছে, সকল নেটব্যবহারকারী, যারা ইলেকড্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তথ্য আদানপ্রদান, সংরক্ষণ কিংবা শেয়ার করেন তাঁদের সবাইকে৷ সংযুক্ত করা হয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, সার্চ ইঞ্জিন, হোয়াটস্যাপ, টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম সহ সামাজিক মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম বা মাধ্যমগুলিকে৷ সেগুলিতে যাতে সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করে কোনও পোস্ট না হয় তার নজরদারি ও বিচার করবে ‘ফ্যাক্ট চেক ইউনিট’৷ হোয়াটস্যাপের ক্ষেত্রে তথ্য ছবি ও ভিডিও লেনদেনে ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ চালু আছে ২০১৩ সাল থেকে৷ যাতে একটা ডিভাইস থেকে বার্তা বা ছবি যে ডিভাইসে পাঠানো হয় কেবলমাত্র সেটির মালিকই দেখতে পারে, অন্য কেউ নয়৷ এখন নয়া আইটি রুলসে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, কে কাকে প্রথম সংবাদ বা তথ্য ইত্যাদি পাঠিয়েছে, কে পরে পাঠিয়েছে, কে গ্রহণ করছে তা চিহ্ণিত করা যাবে৷ ফলে ব্যক্তি ও তথ্যের গোপনীয়তা বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না৷ এর ফলে যে কোনও লোককে শিকার বানানো শুধু সরকার নয়, দুষ্কৃতী ও হ্যাকারদের কাছেও আরও সহজ হয়ে উঠবে৷
২০১৫–তে সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬–এ ধারাকে বাতিল করে৷ সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য ছিল, সংবিধান প্রদত্ত বাক স্বাধীনতার অধিকারকে ৬৬–এ ধারা অস্বীকার করছে৷ এই আইনের বলে সরকার কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তথ্য ও সংবাদকে ক্ষতিকারক বলে মনে করলেই কঠোর শাস্তি দিতে পারত৷
আইটি রুলসের নয়া সংশোধনী ২০২৩, দুই দিক থেকে অকার্যকরী এবং অবাস্তব৷ প্রথমত কোনও সংবাদকে নির্ভুলভাবে ভ্রান্ত বা ফেক হিসাবে নির্ধারণ করতে হলে যে যত্নে তা যাচাই করা দরকার কোনও ডিভাইসের সাহায্যেই তা তৎক্ষণাৎ করা যায় না৷ দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষ দূরের কথা, এমনকি দেশের বহুল প্রচলিত বেশিরভাগ সংবাদপত্র, সংবাদ চ্যানেল বা মিডিয়ার হাতে ফেক নিউজ বাছার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামো, লোকবল এবং তার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই৷ এই সুযোগে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’–এর নামে বিজেপি সরকার সংবাদমাধ্যমের প্রতিটি শাখাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও নিজেদের তাঁবে রাখতে চাইছে, যা চরম স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈরতন্ত্র ব্যতীত ভিন্ন কিছু নয়৷ নিরপেক্ষতা ও সদিচ্ছা থাকলে প্রচলিত আইনেই ভ্রান্ত ও মিথ্যা সংবাদ, ঘৃণা–বিদ্বেষ ভাষণ ইত্যাদি অনেকাংশেই প্রতিহত করা যায়৷ তার জন্য সরকার জনসাধারণকে সজাগ ও সচেতন করতে পারে৷ কিন্তু বাক স্বাধীনতা কেডে নেওয়া অথবা বিচারব্যবস্থার কাজ প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার তাদের নেই৷
বুম লাইভ, ফ্যাক্টলি, দি লজিক্যাল ইন্ডিয়ান, বিশ্বাস নিউজ, দি কুইনট ইত্যাদি ওয়েবসাইটগুলির মিলিত ১৪ টি সংস্থা নিয়ে গঠন করা হয়েছে ‘মিসইনফরমেশন কমব্যাট অ্যালায়েন্স’(এমসিএ), বা ভ্রান্ত তথ্য প্রতিরোধ জোট৷ যারা সরকারের নেটওয়ার্ক ‘ফ্যাক্ট চেক ইউনিট’–এর অংশ হিসেবে কাজ করবে৷ এদের বেশিরভাগই নিজেদের ওয়েবসাইটের ফ্যাক্ট চেক করে না৷ কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইটগুলিকে এমসিএ জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷ যার মধ্যে মহম্মদ জুবেইর এবং প্রতীক সিনহার ‘অল্ট নিউজ’ ওয়েবসাইটও আছে, যারা মিথ্যা বা ফেক নিউজ এবং কৃত্রিমভাবে বানানো ভিডিও ইত্যাদি শনাক্তকরণে বিশেষভাবে পারদর্শী৷ ইতিমধ্যে ইংরেজি দৈনিক ‘দি হিন্দু’ ৭ দিন ধরে (৭ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল’২৩) উপরোক্ত ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইটগুলির ১৪২টি বৃহৎ নিবন্ধ বিশ্লেষণ করে বলেছে, ‘কেন্দ্রীয় সরকার, শাসক বিজেপি দল ও আরএসএস–এর সম্পর্কিত নিবন্ধগুলির ২৮ টি ভ্রান্ত বা ফেক নিউজ’ (দি হিন্দু––২২.৪.২০২৩)৷
বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে ১৯২৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ আদালতে ক্যারোলেট অনিটা হুইটনি বনাম পিপল অব দি স্টেট ক্যালিফোর্নিয়া মামলায় বিচারপতি লুইস ব্রানডেসিসের রায় এত বছর পর আজও প্রাসঙ্গিক৷ হুইটনির বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ ছিল, তাঁর বক্তব্য সমাজে জনশৃঙ্খলা (পাবলিক অর্ডার) বিনষ্ট করছে৷ বিচারপতি ব্রানডেসিস বলেন, সরকারের সমালোচনা করলে শাস্তি দেওয়া গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার সামিল৷ বাক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের হৃদয় স্বরূপ৷ কোনও অবস্থাতেই মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া বা ছেঁটে ফেলা যায় না৷ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম তাত্ত্বিক টমাস জেফারসন বলতেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতাই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ৷ … সংবাদপত্রহীন একটি সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র এই দুইয়ের মধ্যে আমি কোন পক্ষে, যদি আমাকে বলতে বলা হয়, এক মুহূর্তেই নির্দ্বিধায় বলবো আমি সরকারবিহীন সংবাদপত্রের পক্ষে৷’
আইটি রুলস সংশোধনী ২০২৩ বাতিলের দাবিতে ইতিমধ্যে আদালতে মামলা হয়েছে৷ কিন্তু কেবলমাত্র বিচারব্যবস্থার উপর নির্ভর করে ওই স্বৈরাচারী আক্রমণকে প্রতিহত করা যাবে না৷ একমাত্র দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের পথেই এই আক্রমণকে রুখে দেওয়া সম্ভব, এছাড়া ভিন্ন কোনও রাস্তা নেই৷