তেলঙ্গনায় গিয়ে সম্প্রতি দলিত সম্প্রদায় বলে পরিচিত মাদিগা গোষ্ঠীর নেতাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু হঠাৎ কেন তাঁর এই বিনয়! কারণটা অবশ্যই তেলঙ্গনায় আসন্ন বিধানসভা ভোট। তাঁর দল বিজেপি ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে দস্তুরমতো ইস্তাহার ছাপিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের গদিতে বসলেই তারা মাদিগা গোষ্ঠীকে এসসি তালিকাভুক্ত করে দেবে। তারপর মোদিজি মসনদে কাটিয়ে ফেলেছেন, আরও ন’টা বছর। এখন ভোটের সামনে তাঁর রাজনৈতিক ঝুলি ঝাড়তে গিয়ে মোদি সাহেব বুঝেছেন দেশের মানুষের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে বলবার মতো কোনও কথাই তাতে নেই, তাই তাঁর মনে পড়ে গেল তেলঙ্গনার পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলির কথা!
মোদি সাহেব অবশ্য একটা সত্য নিজের অজান্তেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ দেশ স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কাটিয়ে তথাকথিত ‘অমৃতকাল’-এ উপস্থিত হলেও মানুষের প্রকৃত অবস্থাটি কী! এর সাথে মোদিজির প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে থাকা ন’টা বছরের ফল যুক্ত হয়ে দেশের গরিব দুর্বলতর শ্রেণির মানুষের জীবনকে ক্রমাগত বেশি বেশি করে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তা না হলে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়ে নানা সুবিধার সুযোগ পেয়েও নানা রাজ্যে একের পর এক জাতিগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর তকমা পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে কেন? কেনই বা এক গোষ্ঠী এসটি বা এসসি তকমা নতুন করে পেলে অন্য গোষ্ঠী প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে? মণিপুরের জ্বলন্ত উদাহরণ ছাড়াও বহু রাজ্যেই আজ এই অবস্থা।
মোদিজি জানেন, তিনি যতই ঘন্টায় ঘন্টায় বহুমূল্যের রকমারি পোশাক বদলান না কেন, তাঁর শাসিত ভারতের দৈন্য ঢাকতে পারে এত বড় কোনও আবরণই তাঁর কাছে নেই। তিনি জি-২০-র অতিথিদের থেকে দিল্লির ঝুপড়ি আড়াল করতে ত্রিপল খাটাতে পারেন, কিন্তু বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ভারতের নিচের দিকে দৌড় আড়াল করবেন কী দিয়ে? ক্রমাগত কমছে দেশের লেবার ফোর্স পার্টিশিপেশন রেট অর্থাৎ দেশের কর্মক্ষম মানুষের কাজ পাওয়ার হার। বাড়ছে বেকারত্ব। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কোপে সাধারণ মানুষের দিন গুজরানই কঠিন। মোদিজি বলেছিলেন ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। অথচ দেশের মানুষ প্রতিদিন দেখছে, তাঁর ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিরা চরম দুর্নীতি করে চলেছেন। তেল, কয়লা, শেয়ার মার্কেটে তাদের জালিয়াতি-দুর্নীতিকে প্রকাশ্যে আনার পরিবর্তে তা ঢাকতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লোপাট করে মোদিজির এবং তাঁর দলের ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিরা একের পর এক বিদেশে পালিয়েছে। আদানিদের পাহাড়প্রমাণ ঢাকতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। তার জন্য সমালোচকদের জেলে পুরে কিংবা মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে মোদি সাহেবের ঝুলিতে এমন কিছুই নেই যা দেখিয়ে তিনি আবার জনগণের কাছে ভোট চাইতে পারেন। তাঁর পারিষদবর্গ দীপাবলিতে অযোধ্যায় নদীতে ২২ লক্ষ প্রদীপ ভাসিয়েছেন। কিন্তু যে অন্ধকারে তাঁরা দেশকে ঢেকে ফেলেছেন তা দূর হবে কী করে? পরদিনই মানুষ দেখেছে ঘরে রান্নার সংস্থান করতে ওই প্রদীপের অবশিষ্ট তেল সংগ্রহ করা হতদরিদ্র শিশু-কিশোদের ছবি। তাদের মলিন মুখে হাসি ফোটানোর অ্যাজেন্ডা তো মোদিজিদের বাস্তব কর্মে নেই।
তাহলে, একেবারে চলতি সময়ে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কিংবা আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদিজি প্রচার মিটিংয়ে কী নিয়ে গলা ফাটাবেন? তাঁর ঝুলিতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতপাতের বিভেদের তাস ছাড়া আর তো কিছুই নেই। তাই সে অস্ত্রেরই শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। মণিপুরের পাশের রাজ্য মিজোরামের ভোটে মোদিজি প্রচারে যাওয়ার সাহস করেননি। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, তেলঙ্গনাতে একের পর এক সভায় প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভাষণের কোনওটিতেই এমন কোনও কথা শোনা যায়নি যাতে বোঝা যায় একটা গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের কাজটা কী? মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর কোনটি দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা ভোট চাইছেন? উগ্র হিন্দুত্ববাদের জিগির, জাতপাত এছাড়া কোনও একটা বিষয়ও তাঁদের মুখে শোনা যায়নি।
আর আগামী ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের নদী তাঁরা পার হবেন কোন নৌকো চড়ে? ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলোকে চাপা দিয়ে ভোট জোগাড়ের জন্য মোদিজির হাতিয়ার ছিল পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে বিস্ফোরণ এবং তাকে অজুহাত করে বালাকোটে বায়ুসেনার হানা। এককালে বিজেপির অতি ঘনিষ্ঠ, এবং জন্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক কিছুদিন আগে পুলওয়ামা বিস্ফোরণকে কাজে লাগানোর জন্য বিজেপির গেমপ্ল্যান সামনে এনেছেন। তাঁর থেকেই জানা গেছে, এই ঘটনার পরেই রাজ্যপাল হিসাবে সত্যপালজি মোদিজিকে ফোন করায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এ বিষয়ে এখন চুপ করে থাকো। সেনাবাহিনীর সাধারণ জওয়ানদের জীবনকে ভোটে জেতার দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারে যারা, তারা আগামী নির্বাচনের আগে চমক সৃষ্টি করতে কী ঘটাবে তা এখনই বলা না গেলেও ওদের কার্যধারা বলে ওই ধরনের কিছু চমক আসতেও পারে! অপাতত লোকসভা ভোটের আগে জানুয়ারিতে রামমন্দিরের উদ্বোধন নিয়ে তাঁরা দেশজুড়ে হইচই বাঁধাতে উদ্যোগী। নরেন্দ্র মোদি সেই উদ্বোধনে রামলালার মূর্তি বয়ে নিয়ে গিয়ে হিন্দুত্বকূলতিলক সাজবেন। সেই ছবি প্রচার করে বিজেপি ভোটের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে নামবে। সত্যপাল মালিকের আশঙ্কা মতো রামমন্দিরে বোমা ফাটিয়ে নতুন ভোট-চমক বিজেপি দেবে কিনা আগে থেকে বলা শক্ত। তবে আদর্শগত দিক থেকে এবং জনজীবনের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে বলার ক্ষেত্রে একেবারে দেউলিয়া বিজেপির সামনে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতি ছাড়া অন্য পথ নেই। মনে রাখা ভাল উত্তরপ্রদেশে ২০১৭-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুজফফরনগরে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছিল এই বিজেপি। যদিও একটা কথা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিজেপি নেতারাও তা বুঝতে পারছেন, দেশের মানুষের ক্ষোভের আগুনকে স্তিমিত করা রামমন্দিরের চমক দিয়ে সহজ হবে না। সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের বিভেদের ঝুলি কেড়ে নিলে মোদিজি যে সত্যিই রাজনৈতিকভাবে ফকির হয়ে পড়বেন।