সংসদে দাঁড়িয়ে আবার একটি নির্জলা মিথ্যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ১২ মার্চ তিনি রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, এনপিআরের জন্য নাগরিকদের কোনও কাগজ দেখাতে হবে না, কোনও তথ্য জানা না থাকলে তা না দিলেও চলবে। তথ্য প্রদান সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক এবং তথ্য না দেওয়া বা অসম্পূর্ণ তথ্যের জন্য কোনও ভোটার বা নাগরিককে সন্দেহজনক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে না।
সন্দেহ নেই দেশজোড়া সিএএ-এনপিআর-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সামনে চাপে পড়েই তাঁর এই বিবৃতি। যাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে আন্দোলন থেকে সরে যায় সেই চেষ্টাই করেছেন অমিত শাহ।
কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেননি দেশবাসী। কারণ তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, এর আগেও বহুবার সংসদে দাঁড়িয়েই মিথ্যা বলেছেন অমিত শাহ। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে যখন অমিত শাহ লোকসভায় দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন কাশ্মীরের পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাকে আদৌ আটক করেনি সরকার, সেই সময় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের আটক থাকার মেয়াদ এক মাস ছাড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি শেষ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফারুক আবদুল্লার উপর ‘পিএসএ’ প্রয়োগ করে বিনা বিচারে তাঁকে আটকে রাখার সুযোগ করে নেয় অমিত শাহেরই মন্ত্রক।
ফলে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে এবারেও কি সত্য বললেন অমিত শাহ! না, তিনি সত্য বলেননি। তা হলে তাঁকে বলতে হত ১৯৫৫-র মূল নাগরিকত্ব আইনের উপর সংশোধনী এনে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনের যে বিধি (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেন অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) চালু করেছিল অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার, তার ৩, ৪, ৫, ৫(ক), ৫(খ) , ৬(ক), (খ) এবং (গ) ধারা তাঁরা বাতিল করছেন। কিন্তু ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এনপিআর করার জন্য যে নোটিস জারি করেছে তাতে ২০০৩-এ নাগরিকত্ব রুল ৪-এর ৪ নম্বর উপধারা অনুযায়ী ১ এপ্রিল ২০২০ থেকে এনপিআর করা হবে বলে জানানো হয়েছে। যে ধারায় আছে, কারও উত্তর দেখে যদি স্থানীয় রেজিস্ট্রারের মনে হয় উত্তরগুলি সন্দেহজনক, তা হলে তথ্য সংগ্রহ শেষ হওয়ার পর সেই পরিবারকে নির্দিষ্ট প্রোফর্মায় জানানো হবে যে, তাঁরা সন্দেহের তালিকায় আছেন। পরবর্তীকালে তাঁদের বক্তব্য শোনা এবং সন্দেহজনক নাগরিকদের তালিকা তৈরির পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে লোকাল রেজিস্ট্রারের। এই রেজিস্ট্রারের সিদ্ধান্ত অনুসারেই ঠিক হবে কার নাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে থাকবে, কাকে বাদ দেওয়া হবে। এরই সাব রুল ৫ বলছে, পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর)-এর তথ্য যাচাই করেই তৈরি হবে ভারতীয় নাগরিকদের তালিকা অর্থাৎ নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি।
কী তথ্য দিতে হবে এনপিআর-এ? ২০১০ সালে যে এনপিআর হয়েছিল তাতে মূলত দেখা হয়েছিল কোনও ব্যক্তি বিগত ৬ মাস কোন এলাকায় বাস করেছেন এবং আগামী ৬ মাসও সেখানেই থাকবেন কি না। সরকারের বক্তব্য ছিল, যেহেতু আজকের দিনে মানুষ ঘন ঘন কর্মস্থল পরিবর্তন করে, ফলে অল্পদিনেই শহর বা গ্রামের জনসংখ্যাগত (ডেমোগ্রাফিক) চরিত্র বদলে যায়। তাই জনগণনার পাশাপাশি এই সমীক্ষা দরকার। জনগণনায় যেভাবে প্রতিটি ব্যক্তি এবং পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি সহ নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয় তা এনপিআরের জন্য দরকার হয় না। অথচ এবার কেন্দ্রীয় সরকার এইটুকু তথ্য সংগ্রহের নামে গতবারের ১৫টির সাথে আরও ৮টি প্রশ্ন যুক্ত করেছে। যার মধ্যে আছে মাতৃভাষা কী, এর আগে কোথায় ছিলেন, নিজের এবং বাবা-মায়ের জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান কোথায়, ইত্যাদি। তার সাথে দিতে বলা হয়েছে আধার নম্বর, বায়োমেট্রিক প্রমাণ, ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি। নিছক ডেমোগ্রাফিক তথ্যের জন্য এগুলির কোনও প্রয়োজন যে হতে পারে না, তা মানুষ সহজেই বুঝতে পারছেন।
সরকার বলছে, ১ এপ্রিল থেকে প্রথমে এনপিআর চালু হবে সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনীর ছাউনিতে, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকা সহ প্রতিরক্ষা বাহিনীর নানা অফিস ইত্যাদিতে। তারপর হবে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কেউ যদি জানান বাবা বা মায়ের জন্ম কোথায় তিনি জানেন না, তা সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। অথচ এটাই বাস্তব যে বহু মানুষের কাছেই এই ব্যাপারে সঠিক তথ্য নেই। বিশেষত পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের বেশিরভাগের পক্ষে এই তথ্য থাকাটাই কঠিন। গ্রাম এবং শহরের বস্তি এলাকার গরিব মানুষের কাছেও প্রায়শই এই ধরনের দলিল থাকে না। এর উপর কারও বাবা অথবা মায়ের জন্ম পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে তাঁর নাম সন্দেহজনকের তালিকাতে তো ঢুকবেই, আবার এই অস্বস্তি এড়াতে যদি কেউ জানি না বলেন, সেক্ষেত্রেও তিনি সন্দেহভাজন হবেন। আর এই সন্দেহজনক তালিকায় থাকলে তাঁর চাকরিও থাকবে কি না সন্দেহ।
পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ‘দেশ জুড়ে এনআরসি হবেই’ বা ‘এনআরসি করতে আমরা বদ্ধপরিকর’ প্রভৃতি ঘোষণা বহুবার শোনা গেছে মোদি সরকারের মন্ত্রীদের মুখে। মোদি সরকারের দুই মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বা কিরণ রিজিজু বলেছেন, এনপিআর হল এনআরসি-র প্রথম ধাপ। এনপিআর ও এনআরসি রূপায়ণ যাদের হাতে, সেই রেজিস্ট্রার জেনারেল অ্যান্ড সোস্যাল কমিশনের বার্ষিক রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়েছে। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে খোদ অমিত শাহ বলেছিলেন ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’, অর্থাৎ ধারাবাহিকতাকে বুঝুন। প্রথমে সিএএ, তারপরে এনপিআর এবং তারপরে এনআরসি হবে। দেখা যাচ্ছে মোদি সরকার, অমিত শাহ সহ তাঁদের সকল নেতা-মন্ত্রীরা এনআরসি করা এবং সেই এনআরসি যে এনপিআর-এর পথেই হবে তার পক্ষেই বারে বারে সওয়াল করেছেন। আর আজ দেশজোড়া প্রবল আন্দোলন দেখে অমিত শাহ বলছেন, এনপিআর-এ কোনও তথ্য দেওয়া না-দেওয়া ঐচ্ছিক বিষয়। এ নিয়েও মিথ্যাচার করলেন তিনি। এর আগে অমিত শাহ নিজে মুখে বলেছেন, আধার ইত্যাদি থাকলে তা দেবে না কেন? স্বরাষ্ট্র দফতরের লিখিত নোটিসে এই ‘ঐচ্ছিক’ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে– ঐচ্ছিক বলতে বোঝায়, কারও যদি ওই ডকুমেন্টগুলি না থাকে তা হলে তা না দিয়েও তিনি এনপিআর ফরম ভরতে পারবেন। কিন্তু থাকলেও তা না দিলে তথ্য গোপন বা বিকৃত করার সামিল বলে ধরা হবে (ইন্ডিয়ান এ’প্রেস, ২৫.১২.২০১৯)। কোন অমিত শাহ সঠিক? আজকের চাপে পড়া ভিজে বিড়ালটি, না গত ডিসেম্বরের গর্জনশীল বাঘ-সাজা নেতাটি?এর পরেও তিনি যখন বলেন, সরকার শুধু এনপিআর করার নির্দেশিকা দিয়েছে, এনআরসি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি– সে কথা কি মানুষ বিশ্বাস করবে? সে জন্যই দেশজুড়ে আওয়াজ উঠেছে ২০১০-এর আকারে এনপিআর ফিরে না এলে একটি প্রশ্নের উত্তরও মানুষ দেবে না। মানুষের এই ক্ষোভ আন্দাজ করে একের পর এক রাজ্য সরকার এনপিআর স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আসামের এনআরসি প্রক্রিয়াতে দেখা গেছে বহু সেনা বা আধা-সেনা কর্মী, এমনকি যুদ্ধে নিহত সেনাকর্মীর পরিবার বা সরকারের দ্বারা শৌর্যচক্রে ভূষিত সেনাকর্মীও এনআরসি তালিকা থেকে বাদ গেছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারও এনআরসিতে বাদ পড়েছে। আসামে চেষ্টাটা ছিল ভাষাগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হয়রানি করা। এখন দেশ জুড়ে যে এনপিআর এবং তারপর এনআরসি প্রক্রিয়া সরকার আনতে চাইছে তাতে হয়রানির শিকার হবেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত এবং গরিব মানুষ তো বটেই, কোনও ধর্ম-বর্ণের নিরীহ সাধারণ মানুষই বাদ যাবেন না। এই হয়রানি থেকে বাঁচতে তাঁদের ছুটতে হবে শাসক দলের নেতাদের দরজায়, তাদের নজরানা দিয়ে, সেবা করে কেউ কেউ হয়ত উদ্ধার পাবেন। বাকিরা চাকরি, রোজগার, পরিবার প্রতিপালনের মূল সমস্যা ভুলে ছুটে বেড়াবেন আজ এই কার্ড, কাল ওই কার্ড সংগ্রহের পিছনে। হকের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার আশাতেই জীবনের মূল্যবান সময় শেষ হয়ে যাবে বহু মানুষের।
বিজেপি সরকার বারবার জানিয়েছে এনআরসি চালু করতে তারা বদ্ধপরিকর। অমিত শাহ নিজে বলেছেন সিএএ থেকে তাঁরা এক ইঞ্চিও পিছু হটবেন না। এনআরসি, সিএএ বিরোধী আন্দোলন ধ্বংস করতে পুলিশ, প্রশাসনকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করে আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী বা সন্ত্রাসবাদী তকমা লাগিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর জন্য বিচারব্যবস্থার উপরও তারা প্রভাব খাটাচ্ছে। সেখানে এনপিআর-কে এনআরসি রূপায়ণের কাজে যে ব্যবহার করা হবে না, তা শুধু অমিত শাহের মুখের কথার ভিত্তিতেই মেনে নেওয়া যায়? যদি সত্যিই অমিত শাহদের সৎ উদ্দেশ্য থাকত, তবে তাঁদের উচিত ছিল এনআরসি এবং সিএএ আইন বাতিল করা এবং ২০১০-এর প্রক্রিয়াতেই এনপিআর করার কথা ঘোষণা করা। তা না করে এনপিআর বিরোধ়ী আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য মানুষকে বোকা বানাতে চাইছেন তাঁরা।
দুষ্টের নাকি ছলের অভাব হয় না। কিন্তু তারাই শেষ কথা বলে না। ছল একদিন না একদিন ধরা পড়েই। আজ ধরা পড়েই বিজেপি নেতারা নানা রকম কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। কিন্তু এই সর্বনাশা ষড়যন্ত্রকে দেশের মানুষ কোনও ভাবেই কার্যকরী করতে দেবে না।