অল ইন্ডিয়া কিষাণ-খেতমজদুর সংগঠন (এ আই কে কে এম এস)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ১-২ মার্চ সারা রাজ্যে কিষাণ মার্চের ডাক দিয়েছে। তাদের প্রধান দাবি এনপিআর-এনআরসি-সিএএ বাতিল করতে হবে। কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, খেতমজুরদের সারা বছর কাজ দিতে হবে। এছাড়া কৃষক ও খেতমজুরদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধান করতে হবে। এই দাবিতে ইতিমধ্যে গ্রামাঞ্চলে হাটে হাটে সভা, মিছিল, এলাকায় বৈঠক ইত্যাদি কর্মসূচি চলছে। স্থানীয় স্তরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ১ মার্চ রাজ্যের চারটি জায়গা থেকে বিশাল কৃষক মিছিল রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র উত্তরকন্যা ও নবান্নের দিকে অভিযান শুরু করবে। উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি থেকে কৃষকরা যাবে শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যায়। দক্ষিণবঙ্গে জয়নগর, মেচেদা, হাবড়া থেকে কৃষকরা অভিযান করে নবান্নে যাবেন। ২ মার্চ কলকাতার রামলীলা পার্কে অনুষ্ঠিত হবে বিরাট কৃষক সমাবেশ। বক্তব্য রাখবেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ, সভাপতিত্ব করবেন রাজ্য সভাপতি কমরেড শেখ খোদাবক্স। প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখবেন এসইউসিআই (সি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য।
কিষাণ মার্চ-এর দাবি * সর্বনাশা এনআরসি-সিএএ-এনপিআর বাতিল করতে হবে, * ধান-পাট-আলু সহ সব ফসলের লাভজনক দামের ব্যবস্থা করতে হবে। ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি কমপক্ষে ২,৫০০ টাকা দিতে হবে, * সমস্ত কৃষকের কৃষিঋণ মকুব করতে হবে, * রাজ্য সরকারকে জুট করপোরেশন অফ বেঙ্গল গঠন করে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে ন্যূনতম ৮০০০ টাকা ক্যুইন্টাল দরে পাট কিনতে হবে, * কৃষিতে ৩ একর পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং তদুর্ধ্ব কৃষি জমিতে চাষের জন্য এক টাকা ইউনিট দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। কৃষককে চাষের জন্য করমুক্ত ডিজেল সরবরাহ করতে হবে। * খেতমজুর সহ সমস্ত গ্রামীণ মজুরদের সারা বছর কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, * সার-বীজ-কীটনাশক ইত্যাদি কৃষি উপকরণের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সস্তা দরে চাষিদের সরবরাহ করতে হবে, * খরা-বন্যা প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভাগচাষি ও কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। প্রকৃত চাষের সাথে যুক্ত ভাগ/লিজ চাষিদের কেসিসি কার্ড ও ব্যাঙ্ক লোনের সুযোগ দিতে হবে, * ষার্টোর্ধ্ব সমস্ত কৃষক ও খেতমজদুদের মাসিক ৬,০০০ টাকা পেনশন দিতে হবে, * জব কার্ড হোল্ডারদের সারা বছরের কাজ ও ন্যূনতম ৩০০ টাকা মজুরি এবং গরিব মধ্যচাষিদের জমিতে কমপক্ষে ১০০ দিন কাজ করাতে হবে। |
এই কিষাণ মার্চ? কেন কৃষকরা এনপিআর, এনআরসি, সিএএ-কে দাবি সনদের প্রথম স্থানে রেখেছেন? কারণ এগুলির মধ্য দিয়ে কৃষক ও খেতমজুররাই ক্ষতি গ্রস্ত হবেন সবচেয়ে বেশি । নানা ডকুমেন্টের বাহানা তুলে দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষকে প্রথমে অনাগরিক বানানো, পরে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং শেষে অধিকারহীন দাস শ্রমিকে পরিণত করার একটা মারাত্মক ষড়যন্ত্র রয়েছে এনপিআর-এনআরসি-সিএএ-র মধ্যে। একে প্রতিরোধ করতে না পারলে সবকিছু হারিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হবে। তাই এ সংগ্রাম অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। বিজেপি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এই সঙ্কট ছাড়াও কৃষকরা বহু মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন। দেশের কৃষকরা খাদ্য স্বয়ম্ভরতার কারিগর। অথচ তাঁদের পরিবারগুলো চরম দুর্দশায় ধুঁকছে। ঋণ-অভাব-অর্ধাহার-অপুষ্টি, বিনা চিকিৎসায়় মৃত্যু, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, খেতমজুরদের সারা বছর কাজ না থাকা ইত্যাদি সমস্যায় কৃষকরা জর্জরিত। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই উদাসীন।
কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কথা কেন্দ্রীয় সরকার বললেও আয় বাড়ানোর কোনও বাস্তবসম্মত সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। সার-বীজ-কীটনাশক সহ নানা কৃষি উপকরণে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিলে উৎপাদন খরচ কিছুটা কম রাখা যেত। সরকার পুঁজিপতি শ্রেণিকে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিলেও কৃষকদের দিচ্ছে না। ফলে কৃষি উপকরণ বিপণনের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো কৃষকদের ঠকিয়ে বিরাট মুনাফা করছে।
পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল পাট। এই পাট কেনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার জে সি আই-কে বাজারে নামাচ্ছে না। ফলে মিল মালিকরা, ফড়ে-পাইকাররা কৃষকদের অভাবি বিক্রিতে বাধ্য করছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকারও কৃষকদের থেকে পাট কেনার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। কৃষকরা জুট কর্পোরেশন অব বেঙ্গল (জেসিবি) গঠন করে সরকারি কৃষকের কাছ থেকে পাট কেনার দাবি জানালেও তৃণমূল সরকার তা উপেক্ষা করে চলেছে। ফলে কৃষকরা মধ্যসত্ত্বভোগীদের শোষণে জর্জরিত। এছাড়া ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধার জন্য কৃষকরা চড়া সুদে মহাজনি ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। খেতমজুরদেরও সারা বছর কাজ নেই । বছরে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ যেমন অপর্যাপ্ত, তেমনি বাস্তবে কোথাওই ১০০ দিন কাজের ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকার। কৃষিতে তিন একর পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ায় দাবি যেমন পূর্বেকার সিপিএম সরকার উপেক্ষা করে গেছে, তেমনি তৃণমূল সরকারও উপেক্ষা করে চলেছে। উপেক্ষিত করমুক্ত ডিজেলের দাবিও। ফলে সমস্যার গভীর আবর্ত থেকে বাঁচতে কৃষকরা আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন।
গোটা দেশে আজ এনপিআর-এনপিআর-সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার। কৃষকরাও পণ করেছে এই মৃত্যু ফাঁদ রুখতেই হবে। আওয়াজ উঠছে এনআরসি-র প্রাথমিক ধাপ এনপিআর বাতিল কর। বধির কেন্দ্রীয় সরকারকে এ কথা শোনাতেই ১-২ মার্চ হাজারে হাজারে কৃষক সামিল হচ্ছেন কিষাণ মার্চে।