ওরা আজ আর কেউ বেঁচে নেই৷ আছে শুধু ওদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট৷ সেই রিপোর্ট অন্তরের হাহাকারকে যেন বাড়িয়ে দিয়ে যায়৷ দুই বছরের সুরিয়া খাতুন, তিন বছরের দেব প্রামাণিক – অকালেই ঝরে পড়ল৷ মোট ৪৪ জন৷ এই পরিবারগুলিতে আজ শুধুই হাহাকার৷ ২৯ জানুয়ারি সকালে বহরমপুরের কাছে দৌলতাবাদে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার শিকার তাঁরা৷ চালকও মারা গেছে৷ সে ছিল বেপরোয়া৷ যাত্রীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সে মোবাইলে কথা বলতে বলতে একহাতে গাড়ি চালাচ্ছিল৷ তাতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় ব্রিজের রেলিং ভেঙে বাসটি আছড়ে পড়ে বিলের জলে৷ তলিয়ে যায় প্রায় ৩৫ ফুট নিচে৷
আমি, আপনি, আমরা – যে কেউই ওই অভিশপ্ত বাসটির যাত্রী হতে পারতাম৷ ভাবলে শিউরে উঠতে হয়! এই হাহাকার তাই আমাদের সকলের৷ প্রশ্ন তাড়া করে কোথায় যাত্রী নিরাপত্তা এটাকে শুধু দুর্ঘটনা বলেই কি এড়িয়ে যাওয়া যায়? অ্যাক্সিডেন্টের উপর কারও হাত নেই– এ কথা বললেই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রচার তবে কোথায় দাগ কাটল? আইন আছে – মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালানো যাবে না৷ কোথায় সেই আইনের প্রয়োগ? কেন প্রয়োগ হল না এতদিন? ৪৪টি প্রাণের কি দাম নেই?
যেমন খুশি বাস চালাব–এটা কি ড্রাইভিং শর্তের পরিপন্থী নয়? তা হলে চলছে কী করে? পরিবহণ নামক যে দপ্তরটি আছে তার কাজ কী? কেন তদারকি নেই? যাত্রীদের জীবন নিয়ে যা খুশি করার বেপরোয়া মনোবৃত্তির কেন শাস্তি নেই? কেন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই? পরিবহণ ব্যবস্থায় এই নৈরাজ্যের দায় কি রাজ্য সরকার অস্বীকার করতে পারে?
রাজ্যে বিপর্যয় মোকাবিলায় একটি দপ্তর আছে৷ তার মন্ত্রীও আছেন৷ এরকম ঘটনাতেও তাঁদের ঘুম ভাঙে না কেন? দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটি উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ দফতরের৷ তারা লিজের ভিত্তিতে দিয়েছিল বহরমপুর পৌরসভাকে৷ তারা আবার অন্যজনকে চালাতে দিয়েছে৷ উত্তরবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার সাথে পৌরসভার চুক্তি হয়েছিল দুটি বাস নিয়ে৷ শর্ত ছিল পৌরসভা তা অন্য কাউকে দেবে না৷ শর্ত যে মানা হয়নি, বাস চলে গেছে বেসরকারি মালিকের হাতে তা সরকারি কর্তারা জানবেন না এটা হতে পারে কি? আরও জানা যাচ্ছে চুক্তিপত্রে নাকি এই দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটির কোনও উল্লেখই ছিল না৷ ছিল অন্য একটি বাসের কথা৷ তা হলে এত বড় বে আইনি কাজ চলছিল কী করে? কাদের মদতে, কাদের স্বার্থে– তার তদন্ত হবে না কেন? কেন দোষীদের শাস্তি হবে না?
সকাল ৭–১৫ নগাদ দুর্ঘটনা৷ সিভিল ডিফেন্সের টিম এল ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট পর৷ কিন্তু সেই টিমে ছিল না কোনও প্রশিক্ষিত ডুবুরি, ছিল না অক্সিজেন মাস্ক্৷ ফলে সিভিল ডিফেন্স ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকে৷ সকাল ৯ টায় এল একটি ক্রেন, ১২টায় আরেকটি৷ কিন্তু ওই গভীরতায় জলের মধ্য থেকে উদ্ধারের উপযুক্ত ছিল না একটি৷ অপরটি সক্ষম হলেও জল থেকে যাত্রী বোঝাই বাস টেনে তোলার জন্য লোহার দড়িই ছিল না৷ বিলের জলে বাসের কাছে পৌঁছানোর জন্য রবারের নৌকো, স্পিডবোট দরকার থাকলেও তা পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেল৷
ফলে উদ্ধারকার্য শুরু করতে দেরি হয়ে গেল ৬ ঘন্টা৷ এভাবেই ৪৪টি প্রাণের বিনিময়ে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের বিপর্যস্ত চেহারা রাজ্যবাসীর সামনে প্রকট হয়ে উঠল৷ তবে দক্ষতার সাথে রাজ্য সরকার একটি কাজ অন্তত করেছে –উদ্ধারে গা ছাড়া ভাব দেখে ক্ষুব্ধ মানুষের উপর লাঠিচার্জ করেছে, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে৷
মৃত্যুগহ্বর থেকে ১৩ জন যাত্রী ক্ষতবিক্ষত হয়েও প্রাণে বেঁচেছেন৷ তাঁদের বাঁচানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের কোনও ভূমিকাই ছিল না৷ স্থানীয় জেলেরা যাঁরা বিলে মাছ ধরার কাছে নিযুক্ত ছিলেন– তাঁরাই বাঁচিয়েছেন৷ সাধারণ মানুষই তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছেন৷ ধন্যবাদ বা প্রশংসা তাঁদেরই প্রাপ্য৷
এই দুর্ঘটনা থেকে কী শিক্ষা নেবে রাজ্য সরকার? সে কি চালকদের বেপরোয়া আচরণে লাগাম পরাবে? পৌরসভার মতো যে সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পৌর পরিষেবা চালু রাখা, তাদের হাতে বাস চালানোর দায়িত্ব দেওয়া থেকে কি বিরত হবে? সরকার কি প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি মহকুমায় বিপর্যয় মোকাবিলার টিমকে উপযুক্ত পরিকাঠামো সহ প্রস্তুত রাখবে? এসব বুঝতে কি আরেকটা দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?