প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কখনও ‘গণতন্ত্রের মন্দির’ বলে সংসদকে প্রণাম করেন, কখনও বা সংবিধানে মাথা ঠোকেন। কিন্তু তাঁর আমলে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর কীভাবে অবরুদ্ধ, বাকস্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার, ব্যক্তির স্বাধীনতা কীভাবে লাঞ্ছিত, ধর্ষিত, তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারি।
অনলাইন সংবাদ পোর্টাল ‘দ্য ওয়্যার’ ১৯ জুলাই জানায়, ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও-র তৈরি সফটওয়্যার পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ভারতে বহু ব্যক্তির ফোনে বেআইনি ভাবে আড়িপাতা হয়েছে। সেই তালিকায় আছেন বহু সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বিরোধী দলের নেতা, শিল্পপতি, প্রতিবাদী সাধারণ মানুষ, এমনকি বিচারপতি থেকে বিজেপির কিছু নেতা-মন্ত্রীও। যাদের সম্পর্কে বিজেপি সরকারের শীর্ষ তিন কর্তার সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে, তাদের ফোনেই নজরদারি চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্রের সংস্থার নানা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চালিয়েছিলেন যে সাংবাদিক, বিজেপি সরকারের রাফাল যুদ্ধবিমান কেলেঙ্কারি সম্বন্ধে প্রথম দেশবাসীকে অবহিত করেছিলেন যে সাংবাদিক, ওই কেলেঙ্কারির ফাইল হাতে পেয়েই রাতারাতি অপসারিত হয়েছিলেন যে সিবিআই প্রধান, রাফাল বিমান প্রস্তুতকারক ফরাসি সংস্থা দাসোর ভারতীয় এজেন্ট, তার বরাত পাওয়া ভারতীয় সংস্থার কর্তা সহ অনেকে আছেন এই তালিকায়। নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ছাড় দিতে অস্বীকার করেছিলেন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা– তাঁর ফোনও পড়েছে নজরদারির আওতায়। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের যে মহিলা কর্মী, তাঁর নামও আছে এই তালিকায়।
২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন দেশের ১৬টি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদসংস্থা একযোগে এই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালিয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী নজরদারির তালিকায় থাকা বেশ কিছু ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করিয়েছে ফরাসি সংবাদসংস্থা ‘ফরবিডেন স্টোরিস’ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তার ভিত্তিতেই সামনে এসেছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ খর্ব করে ভারত সহ একাধিক দেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির এই নজরদারি চালানোর প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, যখনই কোনও সাংবাদিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছেন বা দুর্নীতি ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, ভোট সামনে এসেছে অথবা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়েছে, শাসকদলের কোনও নেতা একটু অন্যদিকে ঝুঁকছেন বলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময়গুলিতেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এলগার পরিষদ সংক্রান্ত যে মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সমাজকর্মী স্ট্যান স্বামী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে প্রাণ হারিয়েছেন, সেই মামলায় অভিযুক্ত একাধিক জনের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফোনে জাল নথি বসাতে স্পাইওয়্যারের ব্যবহার হয়েছিল বলে জানিয়েছে আমেরিকার ডিজিটাল ফরেনসিক গবেষণা সংস্থা ‘আরসেনাল কনসাল্টিং’। একটা নিরীহ ইমেলের মাধ্যমে এই স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অজানা নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ কল, ভিডিও মেসেজ, কোনও বিশেষ লিংক অথবা সাধারণ কল যার মধ্যে স্পাইওয়্যার আছে, স্মার্টফোন ব্যবহারকারী না জেনেই তা গ্রহণ করলে নজরদারির শিকার হয়ে পড়েন। তাঁর অজান্তেই স্পাইওয়্যার তাঁর সব কথা শোনে, ছবি তোলে, তাঁর প্রতিটি চলাফেরার খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়। দীর্ঘক্ষণ ফোন ব্যবহার না করলেও এই ডিজিটাল গুপ্তচর তার কাজ করে যায়। এ জন্য ব্যাটারি এবং মোবাইল ডাটার খরচ এতটাই কম হয় যে, শিকার় হওয়া ব্যক্তির সহজে সন্দেহ হয় না। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে স্পাইওয়্যারের সার্ভারে বসে থাকা নজরদার যদি বুঝতে পারে তাদের শিকার কোনও সন্দেহ করছে এবং ফোনটি সে পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করছে– সঙ্গে সঙ্গে সিগন্যাল পেয়ে স্পাইওয়্যারটি নিজের ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ ঘটায়। ফলে খুব উন্নত ল্যাবরেটরিতে ফোনটি পরীক্ষা না করালে এর অস্তিত্ব বোঝাই দুষ্কর। বিশ্বের বহু দেশে এক সঙ্গে অভিযোগ ওঠায় সাফাই দিতে গিয়ে এনএসও কোম্পানি জানিয়েছে, ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে তারা কেবলমাত্র সরকারগুলিকেই এই সফটওয়্যার বিক্রি করে। অর্থাৎ নজরবন্দি করার এই প্রক্রিয়া সরকারের মদতেই ঘটেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার ভারতের শাসক শ্রেণি এভাবেই ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে চলেছে।
পাশাপাশি, বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও ভারত সরকার কিছুতেই জানাচ্ছে না, তারা এই সফটওয়্যার কবে কিনেছে এবং কীভাবে তা কাজে লাগিয়েছে। এ নিয়ে তদন্তের আদেশ দূরে থাক, সংসদে আলোচনা করতেও তারা নারাজ। পেগাসাস সফটওয়্যারের অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠায় বিশ্বের একাধিক দেশ তা নিয়ে তদন্তের আদেশ দিয়েছে। মাত্র দুটি দেশ তদন্তে নারাজ। এর একটি ভারত। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে ইতিমধ্যেই একটি সরকারি তদন্ত পেগাসাস যে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতাদের ফোনে আড়িপাতার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে তা নিশ্চিত করেছে।
এনএসও কোম্পানির দাবি, তাদের এই নজরদারি সফটওয়্যারের জন্যই নাকি সন্ত্রাসবাদী, অপরাধী, শিশু পাচারকারী, ধর্ষক ইত্যাদিদের উপর নজরদারি করা যাচ্ছে! কিন্তু কোনও দেশের সরকারই মানুষকে জানায়নি সাধারণ মানুষের ব্যক্তি পরিসরে আড়ি পেতে কোথায় কোন অপরাধটি তারা কমাতে পেরেছে। বরং দেখা যাচ্ছে, কমা দূরে থাক, সন্ত্রাসবাদ, নারী ও শিশু পাচার, ড্রাগের কারবার, শিশু-কিশোরীদের উপর নির্যাতন ধর্ষণের দাপট বেড়েই চলেছে। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, সন্ত্রাসবাদী থেকে ড্রাগকারবারি, কিংবা দুর্নীতিবাজ অথবা ধর্ষক– এদের সকলের প্রধান মদতদাতা এবং আশ্রয়দাতা হচ্ছে শাসকরাই। শাসকদের মদত ছাড়া ভারত সহ নানা দেশে অপরাধীরা এতটা লাগামছড়া হয়ে উঠতে পারে কি? তাছাড়া, অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণের কথা যুক্তির খাতিরে ধরে নিলেও প্রশ্ন ওঠে, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বিচারপতিদের উপর নজরদারির অজুহাত কী?
পেগাসাস কিনতে ভারত সরকার কত খরচ করেছে তার হিসাব পাওয়াও কঠিন। তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ সালে ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সচিবালয়’-এর বাজেট ১০ গুণ বাড়িয়ে ৩৩৩ কোটি টাকা করা হয়েছিল। ঠিক তারপরেই ব্যাপকভাবে ভারতে পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু হয়। সাইবার সিকিউরিটির নামে এই দফতরই আড়িপাতার কাজে মুখ্য ভূমিকায় বলে অভিযোগ উঠেছে। নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ হল প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়া, কোন ক্ষমতা বলে তিনি দেশের মানুষের কথায় লাগাম পরানোর কাজ কাঁধে তুলে নিলেন? এ কথার উত্তরও বিজেপি সরকারকেই দিতে হবে।
দেশের আইন বলছে, সরকার যদি অত্যন্ত জরুরি কারণে কারও ফোনে আড়িপাতার দরকার মনেও করে, তাহলে তাকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয় কেন্দ্রের বা রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছ থেকে। পেগাসাসের ঘটনা বলছে, সে আইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার।
আজ ভারত সহ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশে শোষণ-যন্ত্রণা যত বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ মাঝে মাঝে আন্দোলনে ফেটেও পড়ছে। শাসকরা জানে এই বঞ্চিত, রিক্ত, ক্ষুব্ধ মানুষ যদি সঠিক বিপ্লবী রাজনৈতিক আদর্শকে ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তাহলে এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার সমস্ত তাকত, সমস্ত সৌধ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। তাই শাসকরা আজ সামান্য কোনও প্রতিবাদ, সামান্য কোনও ভিন্ন স্বরও সহ্য করতে নারাজ। যে কোনও বিরুদ্ধ মতের গলা টিপতে তারা আজ অতি সচেতন। তাই এইভাবে মানুষের সমস্ত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করার আয়োজন করতে হয়েছে তাদের। এক সময় বুর্জোয়া গণতন্ত্রই ব্যক্তি পরিসরের স্বাতন্ত্র এবং গোপনীয়তার স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখন সেই পরিসরটাও তারা কেড়ে নিচ্ছে। পেগাসাস কেলেঙ্কারি দেখিয়ে দিয়ে গেল, এই বুর্জোয়া ব্যবস্থা আসলে আজ চরম ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মানুষের গলা টিপে ধরে শাসন করতে হচ্ছে তাদের, এ পেশি আস্ফালন বুর্জোয়া ব্যবস্থার স্বাস্থ্য নয়–চরম ক্ষয়ের লক্ষণ। যা তার সারা গায়ে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে বেরিয়েছে। দেখিয়ে গেল, এই ব্যবস্থার ধ্বংস আজ সময়ের অপেক্ষা। সেই ধ্বংসস্তূপের উপর মানুষ জন্ম দেবে নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজের। যে সমাজে বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা কারও দয়ার দান নয়, সচেতন সংঘবদ্ধ মানুষের অর্জিত এক মহান অধিকার হিসাবেই রক্ষিত হবে।