সম্প্রতি ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড ব্যবহারকারীদের অনেকেরই টাকা তাঁদের অজান্তেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে৷ এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও হইচই চলছে৷ কয়েক দিনে খোদ কলকাতার বুকে পুলিশের খাতায় এ জাতীয় ৩০০–র বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ প্রতারিতদের মধ্যে কয়েকজন ব্যাঙ্ক কর্মচারীও রয়েছেন৷ দেখা যাচ্ছে, কানাড়া ব্যাঙ্ক, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, ইন্ডাস ইন্ড ব্যাঙ্ক সহ আরও কয়েকটি ব্যাঙ্কের এক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ডের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গ্রাহকদের অজান্তে তুলে নেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে বিশাল সংখ্যক ব্যাঙ্ক গ্রাহক, যাঁরা এটিএম ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে৷ অনেকেই এখন খোঁজখবর করছেন তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত আছে কি না৷ যে কেন্দ্রীয় সরকার ডিজিটাল লেনদেনকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করছে, তারা গ্রাহকদের এই বিপদে ঠুঁটো হয়ে বসে আছে৷
আমাদের দেশের এটিএম ব্যবস্থা যে সুরক্ষিত নয় তা অনেক আগেই সবার নজরে এসেছে৷ কিছুদিন আগে স্টেট ব্যাংকের ৩২ হাজার কার্ড বাতিল করতে হয়েছিল শুধু এই কারণে৷ যদিও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বলছে এই টাকা ১০ দিনের মধ্যে প্রতারিতরা ফেরত পাবেন, কিন্তু কীভাবে ফেরত দেওয়া হবে তা নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷ মানুষের অভিজ্ঞতা হল, এটিএম থেকে যদি ২ হাজার বা ৫০০ টাকার এক বা একাধিক জাল নোট বেরোয় তা হলে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেও তারা তা বদলে দেয় না৷ যুক্তি হল, এ টাকা যে এটিএম থেকে বেরিয়েছে তার প্রমাণ কোথায়? এটিএম থেকে জাল নোট বেরুলে যে অজুহাতে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ দেয় না, সেই একই অজুহাতে গায়েব হওয়া টাকাও প্রতারিতকে ফেরত দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়৷ এর দায় কোনও ভাবে গ্রাহকদের ঘাড়ে না চাপিয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান চালিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকেই প্রতারিতদের টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে এবং তা যাতে নেয়, সেটা সরকার এবং পুলিশ–প্রশাসনকে দেখতে হবে৷
ব্যাংকগুলির বক্তব্যেই দেখা যাচ্ছে, প্রতারকরা এটিএম মেশিনের যেখানে কার্ড ঢোকানো হয় সেখানে লাগিয়ে দিচ্ছে ‘স্কিমার’ যন্ত্র, যা এটিএম কার্ডে জমা রাখা ম্যাগনেটিক তথ্য পড়ে ফেলতে পারে৷ ফলে কার্ডের সব তথ্য তারা জেনে ফেলছে এবং খুব ছোট ক্যামেরা, যা কিনা ‘কি–প্যাড’–এর দিকে তাক করে বসানো, তা থেকে ‘পিন’ জানছে৷ এসব তথ্য জেনে তারা ‘ডুপ্লিকেট’ কার্ড বানিয়ে ফেলছে এবং ‘পিন’এর সাহায্যে দূরবর্তী কোনও এটিএম থেকে প্রতারকরা গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দিচ্ছে৷ এসব কুকর্ম করার ক্ষেত্রে প্রতারকদের বড় সুবিধাজনক ক্ষেত্র হল অরক্ষিত এটিএম৷ বেশিরভাগ ব্যাঙ্ক ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে বাইরের কোনও বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে এটিএমের কাজ চালাচ্ছে, এটিএমে নিযুক্ত ‘সিকিউরিটি গার্ড’দের ছাঁটাই করছে৷ এখানকার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলির ফুটেজেরও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ হয় না৷ তাছাড়া এখন কেবল বেসরকারি বাঙ্কে নয়, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কেও একই উদ্দেশ্যে অল্প পারিশ্রমিকে চুক্তিতে নিযুক্ত অস্থায়ী কর্মীদের দিয়ে ব্যাঙ্কের সব রকম কাজ করানো হচ্ছে৷ সমকাজে সমবেতনের নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, স্থায়ী কাজে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁডিয়েছে৷ এই সব বেসরকারি সংস্থাগুলির কোনও দায়বদ্ধতা নেই৷ এদের মাধ্যমে তথ্য পাচার হলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকে না৷ এগুলো বন্ধ করলে এ জাতীয় ব্যাঙ্ক জালিয়াতিও অনেকাংশে প্রতিহত হতে পারে৷ তবে এইসব ‘ক্লোনিং’এর আরও বহু রাস্তা রয়েছে৷ জালিয়াতরা প্রতারিত করার নিত্য নতুন রাস্তা আবিষ্কার করছে যা প্রতিহত করার ব্যবস্থা ব্যাঙ্কের নেই৷ কেন্দ্রীয় সরকার ডিজিটাল লেনদেনে মানুষকে অভ্যস্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ‘ইনসেন্টিভ’ দিচ্ছে৷ অথচ এই দুষ্কৃতীদের দমন করার কোনও কার্যকরী উদ্যোগ সরকারের নেই৷ ডিজিটাল লেনদেনকে সম্প্রসারিত করে দেশি–বিদেশি কিছু বেসরকারি সংস্থাকে বাজার পাইয়ে দিতে তারা তৎপর৷ কিন্তু উদ্যোগ নেই প্রযুক্তিগত সমস্যা গুলিকে দূর করার৷ তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ‘কোয়ালকম’এর মতো অভিজ্ঞ সংস্থা বলছে, ভারতবর্ষে ডিজিটাল লেনদেনের যে বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে সবগুলির ক্ষেত্রেই গ্রাহকদের পূর্ণ নিরাপত্তা নেই৷ এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়৷ পুঁজিপতিদের সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে সরকার সব রকম প্রচেষ্টা চালাতে ব্যস্ত, অথচ সাধারণ মানুষের এমন বিপদে কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কোনও উদ্যোগ বা ইচ্ছা সরকারের নেই৷
ব্যাংক কর্তৃপক্ষও তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাইছে৷ তারা গ্রাহকদের বিভিন্ন উপায়ে সচেতন করছে এবং সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েই হাত ধুয়ে ফেলছে৷ স্টেট ব্যাঙ্কের এক কর্তার বক্তব্য, জালিয়াতিতে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা খোয়া গেলে ব্যাঙ্ক যেহেতু টাকা মিটিয়ে দিচ্ছে তাই গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই৷ প্রশ্ন হল, কখন টাকা চুরি যাবে আর সেই টাকা কীভাবে ফেরত পাওয়া যাবে তার নজরদারি করা আর তদারকি করাই কি গ্রাহকদের মুখ্য কাজ হবে? এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উন্নত প্রযুক্তিগত জ্ঞানের আধারে সমৃদ্ধ হয়ে সতর্ক থাকতে হবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে৷ জিএসটি’র জন্য ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় কর বেড়েছে, বেড়েছে বিভিন্ন পরিষেবার চার্জ, ন্যূনতম ব্যালান্স না রাখার জরিমানা৷ এরপরও টাকার সুরক্ষা রাখার দায়িত্ব কেন নেবে না ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ?
(৭১ বর্ষ ৩ সংখ্যা ১৭ আগস্ট, ২০১৮)