৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস
ভারতে আজ একুশ শতকে সভ্যতার তথাকথিত অগ্রগতির উচ্চশিখরে বসেও ‘পরিপূর্ণ মানুষ’ গণ্য করার দাবি জানাতে হচ্ছে মহিলাদের। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এই ভাবনাটা খুবই প্রাসঙ্গিক।
কেন্দ্রে সরকারে আসীন বিজেপির মতাদর্শগত গুরু আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বাণী–বিবাহ নামক চুক্তিতে নারীর দায়িত্ব পুরুষের ঘর সামলানো। বিনিময়ে পুরুষ নিরাপত্তা সহ নারীর অন্য প্রয়োজন মেটাবে। স্ত্রী যদি এতে রাজি না থাকে, স্বামীর অধিকার রয়েছে তাকে ত্যাগ করার। ফলে এই ভারতে মহিলাদের পূর্ণ মানুষের দাবি জানাতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
মনে পড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যিনি আবার আরএসএসের গর্বিত কর্মী, ক্ষমতায় বসে বলেছিলেন, ‘গৃহিণী হিসাবে মহিলাদের দেখার দিন শেষ, এবার থেকে মহিলারা হবেন জাতি গঠনের কারিগর।’ বলেছিলেন, ‘মাতৃশক্তি আমাদের আসল শক্তি’। প্রধানমন্ত্রীর অতি ভক্তি বিশেষ কিছুর লক্ষণ কি না সে আলোচনা তোলা থাক। কিন্তু তাঁর দলটি যে নারীদের ভোগ্যপণ্যের বাইরে ভাবতেই পারে না, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
জার্মানিতে নাৎসি শাসনে হিটলার মহিলাদের রান্নাঘরে ফেরত পাঠাতে এবং কেবলমাত্র পুত্রসন্তানের জননী পরিচয়ে পরিচিত করার ডাক দিয়েছিল, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে বিজেপি পরিচালিত আজকের ‘আধুনিক’ ভারতে। হিটলারের সুরে সুর মিলিয়ে মোহন ভাগবতই ২০১৩ সালে স্পষ্ট ভাষায় নারীধর্ষণের দায় চাপিয়েছিলেন ঘরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখা আধুনিক নারীদেরই ওপরে। বলেছিলেন, ধর্ষণ হয় ‘শহুরে ভারতে, গ্রামীণ ভারতে নয়।’ দেখা যাচ্ছে, মহাকাশে রকেট পাঠানোর গর্ব করেন যে সরকারের কর্তারা, তারাই পুরুষতন্তে্রর জোয়ালে নারীদের রুদ্ধ করে রাখা ‘পবিত্র কর্তব্য’ বলে মনে করেন। এমনকি পোশাকে নয়, মননে-সংস্কৃতিতে যারা সত্যই আধুনিক চিন্তা ধারণ করেন, তাদের বিরুদ্ধেও এরা দমন নামিয়ে আনে।
বিজেপির মতো শাসক দল সহ ক্ষমতামত্ত দলগুলি মহিলাদের কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে? দেখে পুরুষের অনুগামী হিসেবে, স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসাবে নয়। এ ব্যাপারে তাদের সকলেরই দৃষ্টিভঙ্গি এক। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মোড়কে নারীকে পরিণত করেছে সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে। পুরুষের অধীনেই তার ‘স্বাধীনতা’-র স্বীকৃতি, এ ছাড়া নেই। সমাজ মননে এ চিন্তা নানা কৌশলে এমন ভাবে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এক অংশের মহিলারাও একেই ‘স্বাধীনতা’ বলে মনে করেন। পুরুষের ছত্রছায়ায় থেকে ‘তোমার অধীনেই আমার স্বাধীনতা’ এমন ধারণা পোষণ করেন। আবার মর্যাদাময় স্বাধীন জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্যময় রূপের সন্ধান না পেয়ে অনেক নারী সাজপোশাকের চটকদারিতেই ‘স্বাধীনতার’ স্বাদ খুঁজছেন। সমাজের ভিতরের এই পরিস্থিতিতে খেয়ালখুশি মতো বেপরোয়া জীবনযাপনকে স্বাধীনতা বলে মনে করছেন তাঁরা। স্বাধীনতার বিকৃত ধারণা থেকে যথেচ্ছাচার ও মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন জীবনের মধ্যে তফাৎ করতে পারছেন না। অথচ নারীর অগ্রগতি পুরুষের স্বার্থেই জরুরি। নারীকে অবদমিত করার কৌশল হিসাবে সমাজে স্তূপীকৃত নানা অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তার জঞ্জাল আজ ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে সুকৌশলে ধর্মীয় বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার অশুভ প্রয়াস। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে পছন্দের পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে করার স্বাধীনতা দমন করা হয় ‘লাভ জেহাদ’-এর অজুহাত দিয়ে। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ নরনারীর বিবাহ ‘অনার কিলিং’-এ ক্ষতবিক্ষত। এ তো জীবন্ত জেলখানা। নারীরা মুক্তির জন্য সেই দেওয়ালে মাথা ঠুকে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
অথচ সামন্তী সমাজ ভেঙে বুর্জোয়া সমাজ গড়ার লগ্নে সংগ্রামী জনতার অন্যতম দাবি ছিল নারী-পুরুষের সমানাধিকার। আজ বুর্জোয়া সমাজ যখন অন্তিম লগ্নে এসে পৌঁছেছে, তখনও শুধুমাত্র পূর্ণ মানুষের মর্যাদা পেতে লড়তে হচ্ছে নারীকে। এর থেকে দুঃখের বিষয় আর আছে কী! সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্লোগান তুলে একদিন সামন্তী সমাজের শেকল ভেঙেছিল যে বুর্জোয়া বিপ্লব, প্রচলন করেছিল সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করে কায়েম হওয়া পুঁজিবাদ নিজেও একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা হওয়ায় ভারত সহ বিশ্বের সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্টে্র সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন আজ মালিকী শোষণে বিপর্যস্ত। অর্থনৈতিক সঙ্কটের ধাক্কা, বেকারত্বের জ্বালা, মূল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকা পুরুষদের মতোই আজ নারীজীবনকেও তছনছ করে দিচ্ছে। সমকাজে সমমজুরির অধিকার দূরে থাক, নারীকে শুধু ভোগের বস্তু হিসাবে দেখানোর ষড়যন্ত্র চলছে সমাজ জুড়ে। পুঁজিবাদী শোষণ, দমন-পীড়নকে অবাধে চালাতে শাসকরা মদ ও নোংরা যৌনতার ঢালাও প্রসারে মদত দিচ্ছে। ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। শুধু তাই নয়, মুনাফালোভী পুঁজিতন্তে্রর সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের মিলিত পেষণে আজ মাতৃগর্ভে ভ্রূণের আকারেই শেষ হয়ে যাচ্ছে শত শত শিশুকন্যার অমূল্য প্রাণ। এর বিরুদ্ধে এখনও লড়তে হবে হাজারো লড়াই। নারী ও পুরুষ উভয়েরই সাধারণ শত্রু পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মিলিত অংশগ্রহণ জরুরি। এই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার মধ্য দিয়েই সমাজে নারী মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে।
কাজের সময় কমানো, বেতনবৃদ্ধি, ভোটাধিকারের দাবিতে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৫ হাজার মহিলা-শ্রমিক নিউইয়র্কের রাস্তায় বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। সেই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল সোস্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকা। পরের বছর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক মহিলা সম্মেলনে, বছরের একটি দিন নারী দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর ৮ মার্চ দিনটি নারীদিবস হিসাবে পালন করে আসছেন গোটা বিশ্বের নিপীড়িত নারীরা।
পার হয়ে গেছে একশো বছরেরও বেশি সময়। আজও ২০২২-এর ৮ মার্চে বেঁচে থাকার অধিকার, ‘মানুষ’-এর স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি নিয়ে পথে নামতে হচ্ছে মহিলাদের– এটাই আফশোষের কথা। পুরুষতান্ত্রিক দমন-পীড়ন শুধু নয়, পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের জোয়ালে মহিলাদের অধিকার প্রতি মুহূর্তে খর্ব হচ্ছে। এই দ্বৈত শোষণের বিরুদ্ধে মর্যাদার লড়াই, অধিকারের লড়াই ব্যতিরেকে ৮ মার্চ নারী দিবস উদযাপন শুধু একটা প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কী!