আর কোনও টালবাহানা নয়, একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের হাতে কৃষিকে সম্পূর্ণ তুলে দিতে বিজেপি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া তিনটি কৃষি আইন, জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল অবিলম্বে বাতিল করো– ২৭ সেপ্টেম্বর সারা ভারত জুড়ে ধ্বনিত হল এই দাবি।
২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিন কালা কৃষি আইনে সই করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। সারা দেশের কৃষক, মজুর, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে নিত্য ঘর সামলানো গৃহবধূদের কাছে এ এক কালা দিন হয়ে আছে। তাঁদের ভাতের থালা ধরেই যে টান দিয়েছে সরকার। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সেবাদাস হিসাবে দায়িত্বপালন করতে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার পুরো কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্যপণ্যের বাজারটাকেই তুলে দিয়েছে একচেটিয়া মালিকদের হাতে। ২০২১-এর সেই দিনটিতেই দেশজুড়ে বনধের ডাক দিয়েছিল সংযুক্ত কিসান মোর্চা, যার অন্যতম শরিক এ আই কে কে এম এস। ১০ মাসের বেশি সময় ধরে দিল্লি সীমান্তে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। ইতিমধ্যেই ৬০০-র বেশি কৃষক শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন। হরিয়ানার কারনালে পুলিশের লাঠিতে শহিদ হয়েছেন কৃষক আন্দোলনের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক সুশীল কাজল। কেন্দ্রীয় সরকার মাঝে মাঝে আলোচনার ভান করলেও কৃষকদের মূল দাবি নিয়ে আলোচনা তারা সবসময় এড়িয়ে গেছে। ফলে কৃষক এবং সারা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সামনে একটাই রাস্তা সরকার অবশিষ্ট রেখেছে– ধর্মঘটের রাস্তা।
এস ইউ সি আই (সি) বনধে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছিল। সমর্থন জানিয়েছিল শ্রমিক সংগঠন এ আই ইউ টি ইউ সি, ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও, যুব সংগঠন এ আই ডি ওয়াই ও, মহিলা সংগঠন এ আই এম এস এস সহ অন্যান্য বহু গণসংগঠন। বিদ্যুৎ গ্রাহক সমিতি (অ্যাবেকা) বাড়িয়ে দিয়েছিল সমর্থনের হাত। এস ইউ সি আই (সি) কর্মীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশ জুড়ে টানা প্রচার চালিয়ে গেছেন। মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন বিজেপি সরকারের মারাত্মক আক্রমণগুলি। হয়েছে অসংখ্য প্রচার সভা, মিছিল, জাঠা। অসংখ্য বাজার কমিটি, ব্যবসায়ী সমিতি, হকার সংগঠন, ক্লাব, ব্যাঙ্ক, সামাজিক সংগঠন সকল স্তরেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে চিঠি– দেশের অন্নদাতা কৃষকদের আহ্বানে সাড়া দিন, বনধকে সর্বাত্মক করে তুলুন। সর্বত্রই মানুষ এই আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছেন।
২৭ সেপ্টেম্বরের বনধ তাই সারা ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের বাঁচার রাস্তা খোলার মরিয়া চেষ্টা। সকাল থেকেই দিল্লি অভিমুখী সমস্ত হাইওয়ে কৃষকদের অবরোধে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মিরাট, গাজিয়াবাদ, সিংঘুর দিক থেকে দিল্লির রাস্তা যেমন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তেমনই সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে দিল্লি-অমৃতসর হাইওয়ের উপরে কুরুক্ষেত্রের শাহবাদ। এক সাংবাদিক মন্তব্য করেন, রাজধানী আজ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দিল্লির এনআরসি আন্দোলনখ্যাত শাহিনবাগে মিছিল ও সভা হয়। দিল্লি শহরের নানা স্থানে বিক্ষোভে অংশ নেন শ্রমিক কর্মচারী ও অন্যান্য পেশার সাধারণ মানুষ। সারা উত্তর ভারতে রেল পরিষেবা কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। এসকেএম এবং এআইকেকেএমএস-এর নেতৃত্বে হরিয়ানার সোনেপত স্টেশনে সারা দিন অবরোধ চলে। রেওয়াড়িতে বিশাল কৃষক সমাবেশ ও মিছিল হয়। মধ্যপ্রদেশের গুনায় এআইকেকেএমএস-এর পক্ষ থেকে হয় রাস্তা অবরোধ। দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ সহ নানা রাজ্যে বহু সরকারি অফিস খোলেনি।
উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম ভারত জুড়ে বনধের প্রভাব ছিল সর্বত্রই। বিজেপি শাসিত গুজরাটে বনধ ভাঙতে শান্তিপূর্ণ মিছিলকারীদেরও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একইভাবে আসামের গুয়াহাটিতে প্রতিবাদকারীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনে বিজেপি সরকারের পুলিশ, শিলচর, তেজপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কর্ণাটকের রাইচুর, কালবুর্গিতে রাস্তা অবরোধে সামিল হন কয়েক শত মানুষ। ওই রাজ্যের গুলবর্গাতে বনধের সমর্থনে আগের দিন রাতে মশাল মিছিলে ঢল নামে মানুষের। ওড়িশার নানা স্থানে রেল ও সড়ক অবরোধ ছাড়াও পিকেটিং হয়। ভুবনেশ্বরে গ্রেপ্তার হন ২৫ জন এস ইউ সি আই (সি) কর্মী। পশ্চিমবঙ্গে সকাল থেকেই রেল অবরোধ, রাস্তা অবরোধ হয় জেলায় জেলায়। সর্বত্রই মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। কলকাতা, ঝাড়গ্রাম, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার থেকে ২৭ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কলকাতার হাজরা ও শ্যামবাজার মোড়ে অবরোধ হয়। কলেজস্ট্রিটে এ আই ডি এস ও-র নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তা অবরোধ করেন। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক পোস্ট অফিস, নিমতৌড়ি মোড়ে বিক্ষোভ হয়। কোচবিহার থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সমস্ত জেলাতেই বিক্ষোভ, পিকেটিং চলে।
এই বনধকে সর্বাত্মক সফল করার জন্য জনসাধারণকে অভিনন্দন জানিয়ে সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতা ও এ আই কে কে এম এসের সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান এবং সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ বলেন, দশ মাস ধরে চলা বীরত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের প্রতি এটা দেশের জনগণের আন্তরিক সমর্থনেরই প্রকাশ। এই আন্দোলন শুধু কৃষকদের আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন দেশ-বিদেশের একচেটিয়া পুঁজির আক্রমণের হাত থেকে সর্বস্তরের জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষার আন্দোলন। দেশে বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে যে নতুন ধরনের ঐক্য গড়ে উঠেছে তা একচেটিয়া পুঁজির আক্রমণ প্রতিরোধে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করবে। তাঁরা বলেন, ‘জয় আমাদের নিশ্চিত। আমরা লড়ব, আমরা জিতব।’