বিগত পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল, ভোট প্রক্রিয়ায় কোনও ভোটকর্মী মারা গেলে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন৷ এমনকী আহত বা আক্রান্ত হলেও চিকিৎসার জন্য বা ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ বরাদ্দ হবে৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, কর্তব্যরত অবস্থায় রায়গঞ্জের প্রিসাইডিং অফিসার শিক্ষক রাজকুমার রায় হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও কমিশনের পক্ষ থেকে কোনও নিখোঁজ ডায়েরিও করা হয়নি৷ নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ২২ ঘন্টা পর ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে রায়গঞ্জের সোনাডাঙ্গিতে রেললাইনের ধারে রাজকুমার বাবুর খণ্ড–বিখণ্ড দেহ পাওয়া যায়৷ কোনও তদন্ত ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর প্রশাসনিক দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হল এটি আত্মহত্যার ঘটনা সঙ্গে সঙ্গে সিআইডিও সেই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই উঠে পড়ে লেগেছে৷
ভোটের আগের দিন থেকে ভোটের জিনিসপত্র জমা দেওয়া পর্যন্ত প্রিসাইডিং অফিসারদের যে প্রবল চাপের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত কাটে (পঞ্চায়েত ভোটে আরও বেশি), তাতে নাওয়া–খাওয়া দূরে থাক, জরুরি শারীরিক কারণেও কাজ থামানোর সময়টুকুও থাকে না৷ সারাদিন দায়িত্বের মধ্যে ডুবে থেকে ওই মুহূর্তে আত্মহত্যার কথা মাথায় আসা কি সম্ভব? তা ছাড়া রাজকুমারের স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহিদুর রহমান থেকে শুরু করে তাঁর পরিবারের সঙ্গে পরিচিত, সকলেই জানিয়েছেন, বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত এই শিক্ষকের জীবনে কোনও অশান্তি ছিল না৷ তাঁর আত্মহত্যার কথা কল্পনাই করা যায় না৷ প্রশাসন বলছে রাজকুমার বাবু ১৪ মে ভোটের দিন সন্ধ্যা আটটা থেকে নিখোঁজ৷ অথচ তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং প্রতিবেশীরা ওই দিন রাতেই ইটাহারের বিডিওকে ঘটনাটি জানালেও তিনি তাতে গুরুত্ব দেননি৷
ভোট গণনার দিন রায়গঞ্জে এসডিওর সামনে বিক্ষোভ দেখিয়ে রাজকুমার রায়ের মৃত্যুর তদন্ত দাবি করেন শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী সহ ভোটকর্মীরা৷ বিষয়টিকে তুচ্ছ করে দেখাতে এসডিও জানিয়ে দেন, এই আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে এত মাতামাতি কেন? ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষক সমাজ৷ প্রতিবাদ করে তাঁরা ঘোষণা করেন কেউ ভোট গণনায় অংশ নেবেন না৷ ফলে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ভোট গণনা৷ কয়েকদিন পর আচমকা কয়েকজন শিক্ষকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং শুরু হয় ধরপাকড়৷ পরপর তিনজন শিক্ষককে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং প্রায় ৭০ জন শিক্ষকের নামে এফআইআর করা হয়৷ রাতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশি হানা শুরু হয়৷ বেতন বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়৷
পঞ্চায়েত নির্বাচনে শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীসহ ভোটকর্মীদের যথাযথ নিরাপত্তা না দিয়ে যেভাবে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে ফেলা হল তাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই৷ বারবার দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ভোট রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনৈতিক কাজে বাধ্য করে ভোটকর্মীদের৷ ভোট কেন্দ্রে কোনও নিরাপত্তা তো থাকেই না, এমনকী ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছে ভোটকর্মীরা কী খাবেন, কী ভাবে থাকবেন, পানীয় জলের বন্দোবস্ত সবকিছুতেই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় তাঁদের৷
রাজকুমার রায়ের মৃত্যুতে প্রশাসন যেমন নির্বিকার, তেমনই সবং বিধানসভা কেন্দ্রে এক শিক্ষক প্রিসাইডিং অফিসারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভোট প্রক্রিয়া চলে৷ চাপের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ওই শিক্ষক৷ দেগঙ্গার ভোটকর্মী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্বশিক্ষক মনিরুল ইসলামকে ভোট কেন্দ্রেই এমনভাবে বেধড়ক মারা হয়েছিল যে মাথায় ১২টি স্টিচ করতে হয়৷ মুখের নিচের চোয়াল ভেঙে দেওয়া হয়৷ চিকিৎসার জন্য তাঁর প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেলেও দপ্তরে দপ্তরে হন্যে হয়ে ঘুরে নির্বাচন কমিশন বা প্রসাশনিক স্তর থেকে কোনও আর্থিক সহযোগিতা তিনি পাননি৷ এখানে উল্লেখযোগ্য, তাঁর এই পরিস্থিতি জানতে পেরে সাধারণ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী–শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সহমর্মিতার অনন্য নজির গড়েছেন৷ বিগত এবং বর্তমান নির্বাচনে এরকম বহু ঘটনা প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসন তাদের কাজ হাসিল করা ছাড়া কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও চিন্তা করে না৷
পঞ্চায়েত ভোটে ডিউটি পালনের পর শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা দেখছেন, সারা পশ্চিমবঙ্গেই তাঁদের অভিজ্ঞতা মোটামুটি এক৷ রাজকুমারের মর্মান্তিক পরিণতির খবর তাঁদের দেখিয়ে দেয় রুখে না দাঁড়ালে তাঁদের সামনে আর কোনও উপায় নেই৷ ফলে শিক্ষিত সমাজ সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে তোলার পথ খুঁজে নেয়৷ এর মধ্য দিয়েই ক্ষোভের আগুন ক্রমশ সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের চেহারা নেয়৷ রাজ্যের বহু জায়গায় মৌনমিছিল, প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হতে থাকে৷ সারা বাংলার প্রতিবাদকে যুক্ত করে কলকাতার রাজপথেও আছড়ে পড়ে হাজার হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী–শিক্ষানুরাগীদের প্রতিবাদ মিছিল৷ দাবি ওঠে, রাজকুমার রায়ের মৃত্যুর সিবিআই তদন্ত, রায়গঞ্জে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি, রাজকুমারের পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও সরকারি চাকরি, মনিরুল ইসলাম সহ সকল আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণের৷ আগামী দিনে কেন্দ্রীয় বাহিনী সহ যথাযথ নিরাপত্তা ছাড়া কোনও ভোট প্রক্রিয়ায় না যাওয়ারও দাবি ওঠে৷
২৮ মে রায়গঞ্জে প্রতিবাদী শিক্ষিত সমাজ গণকনভেনশনের মধ্য দিয়ে তীব্র ধিক্কার জানায়৷ কনভেনশনে উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেন বহু বিশিষ্ট আইনজীবী, শিক্ষক–শিক্ষাবিদ সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি৷ কলকাতার রাজপথে প্রতিবাদ মিছিলে ধ্বনিত হয় ‘কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, আমরা সবাই রাজকুমার৷’ আইনি লড়াইয়ের সাথে সাথে আন্দোলনের ঢেউ প্রশাসনকে আতঙ্কিত করে তোলে৷ ধৃত শিক্ষকদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন৷ নতুন করে শিক্ষকদের গ্রেফতার করার নির্দেশ আপাতত প্রত্যাহার করা হয়৷ ২৪ মে–র প্রতিবাদ মিছিলে দাবি ওঠে আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করতে এবং আগামী দিনে যে কোনও আক্রমণকে প্রতিহত করতে দলমত নির্বিশেষে গডে তোলা হোক একটি সংগঠন৷ ৭ জুন কলকাতার আশুতোষ মেমোরিয়াল হলে ডাক দেওয়া হয় এক কনভেনশনের৷ এই কনভেনশনে উপস্থিত হওয়ার জন্য উত্তরবঙ্গ থেকেও ছুটে আসেন বহু মানুষ৷ উপস্থিত হন প্রধান শিক্ষক সহিদুর রহমান, আক্রান্ত মনিরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার সহ প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী, সম্মানীয় ডাক্তারসহ বহু বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ৷ কনভেনশন থেকেই দলমত নির্বিশেষে গড়ে ওঠে ‘শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী–শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চ’, গঠিত হয় রাজ্য কমিটি৷ নির্বাচন কমিশনে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশনের জন্য দাবিগুলিকে সামনে রেখে চলছে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান৷ এরপর স্বাক্ষর সংবলিত দাবিপত্র নিয়ে জুলাই মাসে প্রতিবাদ মিছিল করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ঐক্যমঞ্চ৷
প্রয়াত শিক্ষক রাজকুমার রায়ের মৃত্যুর প্রতিবাদে এত বড় স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে স্তিমিত হতে দেওয়া চলে না৷ নারীর সম্মান রক্ষার আন্দোলনে কয়েক বছর আগে প্রতিবাদী শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ আর আজ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে প্রাণ হারালেন রাজকুমার রায়৷ আসুন দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে রক্ষার শপথ গ্রহণ করে এগিয়ে চলুক এই আন্দোলন৷
(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)