এই বছর ৫ আগস্ট দিনটা ঘরে অবরুদ্ধ হয়েই কাটল কাশ্মীরবাসীর। বিগত একটা বছর তাঁদের কেটেছে এভাবেই। অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে এক বছর আগে তাঁদের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার ৩৭০ ধারা, রাজ্য হিসাবে স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার, রাজ্যের স্থায়ী অধিবাসীদের জমি-কাজের কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, এর বিনিময়ে রাজ্যে উন্নয়ন আনবে কেন্দ্রীয় সরকার। আসবে শান্তি, প্রতিষ্ঠা হবে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, ব্যবস্থা হবে কর্মসংস্থানের।
এক বছর চলে গেছে, কাশ্মীরের মানুষের জীবনে শান্তি কি ফিরেছে? ঘরের উঠোনে কাঁটাতারের বেড়ার নিষেধাজ্ঞা, রাস্তায় বেরোলেই পদে পদে আপাদমস্তক চেকিং, আশঙ্কায় সিঁটিয়ে থাকতে থাকতে বাস্তবে বন্দি মানুষের জীবনে যেমন শান্তি থাকতে পারে সেটুকু শান্তি পেলেও কাশ্মীরবাসী হয়তো নিজেদের ধন্য মনে করতে পারতেন। কিন্তু সেটুকুও কি পেয়েছেন তাঁরা? আইনের শিক্ষক সওকত হোসেনের টুইটার পোস্টের ভাষায়– ‘উন্নয়ন’ যা চোখে পড়ছে, তা হল কাশ্মীরে হিংসা বৃদ্ধি, বাড়ছে সেনার বুটের শব্দ, অবরুদ্ধ রাস্তাঘাট।
সাংবাদিক নাজির মাসুদি মনে করেন, ৩৭০ ধারার পরিসর ছিল গোটা কাশ্মীরের জন্য। যে কারণে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জন্য ২৫টি আসন খালি রাখা ছিল। আজ ৩৭০ ধারাটিই না থাকায় কাশ্মীরকে মেনে নিতে হবে, পাকিস্তানের দখলে থাকা ওই অংশটির উপর তার আর অধিকার নেই। যা কাশ্মীরীয়তের ধারণার উপর এক নতুন আঘাত। কাশ্মীরের যে নেতারা সংসদীয় গণতন্তে্র বিশ্বাস করতেন, তাঁরাই দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর কয়েকজন মুক্তি পেলেও বাকিরা এখনও বিনা বিচারে বন্দি। সব কিছু স্বাভাবিক দেখানোর বাসনায় বেশিরভাগ দলের নেতাকে আটক করে রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন সরপঞ্চ (পঞ্চায়েত) নির্বাচনের প্রহসন করেছিল। তাতে বিজেপি সব আসনে ‘নিরঙ্কুশ’ জয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল নির্বাচিত সরপঞ্চদের সাথে স্থানীয় গ্রামের মানুষের কোনও যোগাযোগ নেই। এর বিষময় ফল ভুগতে হচ্ছে সেই সরপঞ্চদেরই। তারা যখন সন্ত্রাসবাদীদের টার্গেট হয়ে উঠছেন গ্রামের মানুষ তাঁদের পাশে থাকছে না। এর ফলে একের পর এক সরপঞ্চকে সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। অথচ আগে তাঁরা ছিলেন গ্রামের মানুষের দ্বারা সুরক্ষিত। কাশ্মীরের সংসদীয় রাজনীতির মূলধারায় থাকা বিজেপি ছাড়া সব দলের নেতাকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটক রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁদের মধ্যে তিনজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বর্তমান সাংসদ আছেন। এই রাজনৈতিক শূন্যতার জায়গা নিচ্ছে সন্ত্রাসবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ। কেন্দ্রীয় সরকার তা দেখেও দেখছে না কেন? এই সন্ত্রাসবাদকে জিইয়ে রাখতে পারলে বিজেপির সর্বভারতীয় ভোট ব্যাঙ্কে সুবিধা হবে বলে কি! ২০২০-র প্রথমার্ধেই কাশ্মীরে ২২৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে সন্ত্রাসবাদী হামলা বা সামরিক বাহিনীর গুলিতে।
বাস্তবে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন নামে কেন্দ্রীয় সরকারের যে শাসন কাশ্মীরে চলছে তার সাথে সাধারণ মানুষের যোগসূত্র বলে কিছু নেই বললেই চলে। প্রশাসন ব্যস্ত সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে। তারা গত বছর আগস্টেই ঘোষণা করে দিয়েছিল, সব স্কুল-কলেজ খুলে গেছে। অথচ বাস্তব হল এক বছর পরেও বেশিরভাগ শিশু-কিশোর স্কুলেই যায় না। কলেজেও ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠাতে অভিভাবকরা ভয় পান। রাস্তায় মিলিটারির হাতে কী নির্যাতন অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। বস্তুত বিজেপি এবং অতীতে কংগ্রেস নিজেদের উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে, কাশ্মীরী মানেই সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী–এমন একটা ধারণা দেশে যেভাবে তৈরি করেছে তার প্রভাব সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপর ব্যাপক মাত্রায় কাজ করে। কিশোর-যুবকদের সেখানে সর্বদাই সন্দেহের চোখে দেখে প্রশাসন এবং সশস্ত্র বাহিনী। বর্তমানে কাশ্মীরে কর্মরত কেন্দ্রীয় অফিসারদের মধ্যে মাত্র একজন কাশ্মীরী, বাকি সকলকেই কেন্দ্র পাঠিয়েছে বাইরে থেকে, বিজেপির অ্যাজেন্ডা পূরণের বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে। ফলে তাদের সাথে এলাকার মানুষের মানসিক বিচ্ছিন্নতা অতল খাদের মতো। ফলে প্রশাসন বাস্তবে যা ঘোষণা করে, বলে, তার সাথে গ্রাউন্ড রিয়েলিটি অর্থাৎ প্রকৃত বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। ফলে কিছু কিছু পড়াশোনা ব্যাক্তিগত উদ্যোগে চললেও তা প্রয়োজেনর তুলনায় কিছুই নয়। এর উপর দীর্ঘদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পর অতি পুরনো টুজি মানের ইন্টারনেট চালু হলেও তার সাহায্যে পড়াশোনা করা, সর্বভারতীয় পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ, গবেষণা, করোনা আবহে অনলাইন ক্লাস কিছুই সম্ভব নয়। ফলে কাশ্মীরের ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার বোধেই ডুবে যাচ্ছে।
কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের বিনিময়ে ৪০ হাজার নতুন চাকরির কথা এক বছর আগে ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। বাস্তবে সেখানে বেকারি আকাশ ছুঁয়েছে। ফল বাগিচা, কার্পেট, শাল তৈরি, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্র এক বছর পুরো স্তব্ধ। কাশ্মীর চেম্বার্স অফ কমার্সের হিসাবে কমপক্ষে ৪ লক্ষ মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন করোনার আগেই। তারপর সে সংখ্যা আরও বেড়েছে। অন্তত ৪৭ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছেন কাশ্মীরের ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরা। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ঢাক পেটানোটাও একেবারে শূন্যগর্ভ। তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত সক্রিয় কর্মী (অ্যাক্টিভিস্ট) রাজা মুজাফফর ভাট দেখাচ্ছেন, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা, অন্ত্যোদয়, বিপিএল ইত্যাদির মাধ্যমে রেশনে খাদ্য সামগ্রীর প্রাপ্য থেকে কাশ্মীরের লক্ষ লক্ষ মানুষ বঞ্চিত। কারণ অসাধু অফিসার এবং রেশন ডিলাররা এই সমস্ত গ্রাহকের অন্তে্যাদয়, বিপিএল ইত্যাদি কার্ড চেপে রেখে তাদের জাল এপিএল কার্ড দিয়েছে। আগে অন্তত অফিসারদের মাথার উপর থাকা জনপ্রতিনিধিদের ভোটের ভয় ছিল, এখন কোনও জবাবদিহির দায় নেই। ফলে তারা বেপরোয়া। অন্য সমস্ত ক্ষেত্রেও চলছে সীমাহীন দুর্নীতি। সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে ডাল এবং নিগিন লেকে শিকারা ও হাউস বোটের উপর এমন করে নানা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে যাতে বৃহৎ করপোরেট ছাড়া অন্য সকলে সেখান থেকে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়। অথচ এই প্রশাসনই ১০টি জেলাতে কয়েক কোটি রুশ পপলার গাছ কেটে কয়েদিনের মধ্যে পাচার হতে দিয়েছে। এই গাছ থেকে করোনা ছড়ায় এই গুজব তুলতেও সাহায্য করেছে তারাই।
সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের উপর চলছে বর্বর আক্রমণ। সম্প্রতি প্রশাসন সংবাদমাধ্যমের জন্য যে নির্দেশিকা জারি করেছে তাতে বলা হয়েছে বাস্তবে সরকারের যে কোনও সমালোচনাকেই রাষ্ট্র বিরোধিতা হিসাবে দেখা হবে। জম্মু কাশ্মীর সাইবার পুলিশ হুমকি দিয়ে বলেছে, সাবধানে খবর করুন, আমরা সব দেখছি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র সাংবাদিক মাসরাত জাহারা এবং গওহর গিলানির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ইউএপিএ আইনে মামলা করা হয়েছে। একটি খবরের জন্য থানায় ডেকে ধমকানো হয়েছে পিরজাদা আশিককে। দু বছরের জেল খাটছেন সাংবাদিক অসিফ সুলতান। কাশ্মীরের প্রখ্যাত সাংবাদিক সুজাত বুখারিকে গুলি করে কারা হত্যা করল সেটা রহস্যই থেকে গেছে।
বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল কাশ্মীরকে তারা সারা দেশের সাথে মিলিয়ে দিতে ৩৭০ ধারা বাতিল করছে। এতেই কাশ্মীরে শান্তি আসবে। সেদিন এস ইউ সি আই (সি) বলেছিল এই পদক্ষেপ বিচ্ছিন্নতার শক্তিকেই সাহায্য করবে। কাশ্মীরী জনগণের মর্যাদায় আঘাত লাগবে। যার ফলে যে কাশ্মীরী জনগণ ভারতের সাথে থাকার পক্ষেই একদিন লড়েছে তাদের আহত মানসিকতার সুযোগ নেবে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি। আজকের পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে সে বিশ্লেষণ কত সঠিক ছিল। যত দমন পীড়নের রাস্তায় যাচ্ছে সরকার, তত পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।
আজ দরকার কাশ্মীরের জনগণের গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, ন্যায্য দাবির পাশে দাঁড়িয়ে দেশ জুড়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা। কাশ্মীরের ন্যায্য দাবির পাশে সারা দেশের বামগণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষ যদি দাঁড়াতে পারে, তাহলেই একমাত্র কাশ্মীরের জনগণকে আশ্বস্ত করে বিচ্ছিন্নতা এবং সন্ত্রাসের শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব। নিছক ভোট রাজনীতির চমকে যা হওয়ার নয়।
(সূত্র : দ্য ওয়্যার ১১ জুলাই ২০২০। এনডি টিভি ৪ আগস্ট ২০২০। আনন্দবাজার পত্রিকা ৬ আগস্ট ২০২০)