করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ‘ঘুরে দাঁড়াচ্ছে’ বলে দাবি করে চলেছে বিজেপি সরকার। অর্থনীতি নাকি আবার ছন্দে ফিরবে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারেরই নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশে ৩৩ লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে ভয়ানক অপুষ্টির শিকার প্রায় ১৬ লক্ষ শিশু। ২০২০-র নভেম্বর থেকে থেকে গত এক বছরে ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯১ শতাংশ।
সরকার পরিচালনায় বিজেপির দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশ নেই বলে বিজেপি নেতাদের দাবি। কিন্তু যে আর্থিক বৃদ্ধির কথা তাঁরা বলছেন, তা কি দেশের সাধারণ মানুষের? তা যদি হয় তবে তো তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে! তাহলে দেশে শিশু-অপুষ্টির এই ভয়াবহ চেহারা কেন?
বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় ভারত ক্রমাগত লজ্জাজনক জায়গায় চলে যাচ্ছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডে’ ২০২১-এ অপুষ্টিতে ভারতের স্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম, ২০২০-তেও যা ছিল ৯৪। ভারত রয়েছে অপুষ্টির ‘সিরিয়াস’ ক্যাটাগরিতে। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালেরও পিছনে রয়েছে ভারত। এমনকি মানচিত্রে এক চিলতে জায়গা পাওয়া দারিদ্র্যপীড়িত দেশ ইথিওপিয়া, কেনিয়া, মঙ্গোলিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম ইত্যাদির সঙ্গে ‘শক্তিধর অর্থনীতি’র ভারত প্রতিযোগিতায় রয়েছে যাতে শেষের দিক থেকে প্রথম হয়ে না যায়!
চারটি সূচক দিয়ে নির্ধারিত হয় ‘বিশ্ব ক্ষুধা’ তালিকা। শিশুদের প্রয়োজনীয় পরিচর্যার অভাব, ক্ষীণকায় শিশু, খর্বাকৃতি শিশু এবং শিশুমৃত্যুর হার– সব ক’টির সাথেই যুক্ত মারাত্মক অপুষ্টি। এই সবগুলিতেই ব্যর্থতার কালি মেখেছে ভারত সরকার। এই ভয়াবহ অপুষ্টির কারণ কী? দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে কি ঘাটতি হয়েছে? না। অতিমারির সময়েও উৎপাদন হয়েছে যথেষ্ট। সেই উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার পণ্য হয়ে বহুমূল্যে বিকিয়েছে। কর্পোরেট ফুড কোম্পানিগুলির মুনাফা আকাশ ছুঁয়েছে, তাদের পুঁজি বিদেশের বাজারে জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু সেই খাদ্য দরিদ্র শিশুদের মুখ পর্যন্ত পৌঁছয়নি।
অপুষ্টি দূর করতে শিশুদের প্রয়োজনীয় পরিমাণে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, সবজি খাওয়ানো দরকার। অতিমারিতে বহু পরিবারে রোজগার নেই। সরকারের অপদার্থতা এবং খাদ্য-ব্যবসায়ীদের মজুতদারি-কালোবাজারিতে মূল্যবৃদ্ধি ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। কয়েক গুণ বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। সাধারণ মানুষের আয় কমায় ক্রয়ক্ষমতা কমেছে তিনগুণেরও বেশি। নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যও তারা কিনতে পারছে না। ফলে সুষম খাদ্য দূরের কথা, শিশুরা পেট ভরানোর খাবার থেকেও বঞ্চিত।
করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। বন্ধ মিড-ডে মিল। মিড-ডে মিলে শিশুরা যেটুকু পুষ্টি পেত, তাও নেই। উপরন্তু শিশু-পুষ্টি ছিনিয়ে নিচ্ছে সরকার। ২০২০-র মার্চের সরকারি এক নির্দেশিকায় শিশুখাদ্য থেকে বাদ চলে গেছে ডিমের মতো পুষ্টিকর জিনিস। ডাল, সোয়াবিনও নামমাত্র। আইসিডিএস প্রকল্পেও বরাদ্দ ছিটেফোঁটা, প্রতি শিশুর জন্য সারা মাসে দু’কেজি চাল, দু’কিলো আলু আর তিনশো গ্রাম মুসুর ডাল। এখন আবার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিও বন্ধ। অনেক হইচই-এর পর স্কুলে অভিভাবকদের সপ্তাহে একদিন ডেকে নামমাত্র কিছু খাবার দিতে শুরু করেছে সরকার। ফলে শিশুরা ভুগছে রক্তাল্পতায়। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে না ওঠায় তারা সহজেই রোগাক্রান্ত হচ্ছে, তাদের বুদ্ধি ও চিন্তার বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে আগামী কয়েক প্রজন্ম পড়তে চলেছে ভয়াবহ সংকটের মুখে। কেন্দ্রীয় সরকারের এ সমস্ত অজানা নয়। কিন্তু তবু তারা কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন? কারণ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা কর্পোরেট মালিকদের সেবায় দায়বদ্ধ, সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই। তাই দেশের উপচে পড়া খাদ্যশস্য (চাল) সরকার মদ কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দিলেও কিংবা এফসিআই-এর গোডাউনে থাকা চাল-গম সমুদ্রে ফেলে দিলেও তা গরিব জনসাধারণের মুখে পৌঁছয় না।
পুঁজিবাদী সমাজের রক্ষক সরকারগুলি তাদের তখত বাঁচাতে পুঁজি মালিকদের স্বার্থেই সমস্ত নীতি কার্যকর করে। সে জন্য পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের মতো বর্তমান বিজেপি সরকারেরও ভোটের দায় ছাড়া গরিবদের প্রতি কোনও দরদ নেই। তাই শিশুদের মর্মান্তিক এই পরিস্থিতি সত্তে্বও গত পাঁচ বছর ধরে শিশুপুষ্টি সহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা খাতে অর্থবরাদ্দ ক্রমাগত কমিয়ে চলেছে বিজেপি সরকার। ২০২১-র বাজেটে আইসিডিএস প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে তারা। খাদ্য সুরক্ষার এত কথা বলেও রেশনকে সার্বজনীন করা এবং রেশন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। উল্টেগণবন্টন ব্যবস্থা অর্থাৎ রেশন যা দরিদ্র পরিবারগুলির কিছুটা ভরসা ছিল, তাও বন্ধ করার চক্রান্ত করছে বিজেপি সরকার। রাজ্য সরকারগুলিও চাল-গম বিতরণের মধ্য দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে! ফলে শৈশব বঞ্চিত হচ্ছে খাদ্যের অধিকার থেকে।
সরকার প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বাড়াচ্ছে, কিন্তু সমাজকল্যাণের মতো খাতে যেখানে সমাজের প্রান্তিক শিশুদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন জড়িত তাতে বরাদ্দ করছে না। কাদের সুরক্ষা দিতে প্রতিরক্ষা বাজেট? দেশের এক শতাংশ ধনকুবেরদের। অতিমারির মধ্যেই ভারতে ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিকের সংখ্যা ৫৮ থেকে বেড়ে ১১৩ হয়েছে। শিশুদের অপুষ্টির কারণ ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি। সরকার ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠী খাদ্যের মজুতদারি করে তা অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করে যাতে বিপুল মুনাফা করতে পারে সে জন্যই সরকার অত্যন্ত জনবিরোধী তিনটি কালা কৃষি আইন এনেছে। যার বিরুদ্ধে এক বছর ধরে কৃষকরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও আদানি কর্তৃপক্ষ খাদ্য ব্যবসায় প্রবেশের কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই পাঞ্জাবে তাদের তৈরি খাদ্য ভাণ্ডারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে চাষিরা। বিজেপি সরকারের পরিকল্পনা, প্রথমে আদানি এবং সরকারি খাদ্য সংস্থা এফসিআই-এর যৌথ কার্যক্রম এবং ধীরে ধীরে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়া। অর্থাৎ আদানি যাতে একচ্ছত্রভাবে এই ব্যবসার মালিক হতে পারে তার জন্য সবরকম সহযোগিতা করছে পুঁজিপতি-প্রেমী বিজেপি সরকার। সরকার হাত ধুয়ে ফেললে আর দেশের খাদ্য বাজার বহুজাতিক পুঁজি-মালিকদের মুনাফার মৃগয়া-ক্ষেত্রে পরিণত হলে শুধু শিশুরা নয়, কোনও সাধারণ মানুষই প্রয়োজনীয় খাদ্য পাবে না। কারণ, খাদ্য-ব্যবসায়ী আদানি কিংবা আম্বানি জনসাধারণের দিকে তাকিয়ে খাবারের দাম ঠিক করবে না। ফলে গরিব মানুষকে ঝাঁ চকচকে ফুড মার্টের শো-কেসের ভেতরে থাকা খাবার দেখেই ‘পেট ভরাতে’ হবে। সেই ভয়ঙ্কর দিনেরই পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানে। সরকারের এই মালিক তোষণ নীতির মোকাবিলা করা সম্ভব শক্তিশালী গণআন্দোলনের পথেই।