এক ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্যে চাষির বারোমাস্যা

‘‘মোদিজি বলেছিলেন প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে নাকি টাকা ঢুকবে। কোথায় কী! উল্টে আমার ঋণ হয়ে গেল ১৫ লক্ষ টাকা’!’– বলেছেন ফিরোজাবাদের এক লঙ্কা চাষি সৌরভ প্রতাপ সিং। দুঃখের সঙ্গে বিদ্রূপের একটা ঝাঁঝ তাঁর কথায়।

যেমন তেমন তো নয়, রীতিমতো ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্য উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা তিনি, যেখানে কেন্দে্রর পাশাপাশি রাজ্যেও সরকারে বিজেপি। দু’পুরুষ ধরে এই বিজেপিকেই সমর্থন করে এসেছে তাঁর পরিবার। আজ বাস্তব পরিস্থিতি মোহভঙ্গ ঘটিয়েছে তাঁর।

বহু বছর ধরে ফিরোজাবাদের এক গ্রামে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া জমিতে লঙ্কা আর ক্যাপসিকাম চাষ করে আসছেন সৌরভ প্রতাপ সিং। নরেন্দ্র মোদি সরকারের দশ বছরের শাসনকালে তাঁর আয় ক্রমাগত কমেছে, বেড়েছে ঋণের পরিমাণ। কেন এমন হল? সৌরভ এর জন্য দায়ী করেছেন বীজ আর সারের ব্যাপক কালোবাজারিকে। আরেকটি কারণ– পর্যাপ্ত বিদ্যুতের অভাব। তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রে যখন ইউপিএ সরকার, রাজ্যে মায়াবতী আর অখিলেশ যাদবের শাসন, তখনও লঙ্কা চাষের অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু বিজেপি শাসনের দশ বছরে পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়েছে। তিনি বলেছেন, আগে ২০ বিঘা জমিতে লঙ্কা চাষে মোটের ওপর খরচ হত বছরে ১০ লক্ষ টাকা। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে সেই খরচ বেড়ে হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা। অথচ ফসল বেচে ঘরে আসে মাত্র ২০ লাখ– ক্ষতি প্রায় ৩৩ শতাংশ! সিং বলেছেন, ‘‘এ বছরের গোড়ার দিকে বাজার একটু ভাল হওয়ায় কোনও রকমে লোকসানের ১০ লাখ টাকা তুলে নিতে পেরেছি। না হলে শেষ পর্যন্ত হয়ত আত্মহত্যার কথাই ভাবতে হত আমাকে’!’

ডবল ইঞ্জিন সরকারের উত্তরপ্রদেশেও চাষির এই হাল! সৌরভ প্রতাপ শুনিয়েছেন দুঃখের সেই কাহিনী। জানিয়েছেন, শুধু ফিরোজাবাদেই নয়, উত্তরপ্রদেশের অন্য এলাকাগুলিতেও সরকারি ‘কিসান সেবা কেন্দ্র’ থেকে যতটা বীজ মেলে, তা প্রয়োজনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মাত্র। বাকিটা কিনতে হয় বাজার থেকে। এর সুযোগ নেয়় কালোবাজারিরা। বীজের কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয় তারা। ফলে যে লঙ্কাবীজের এক কিলোর দাম হওয়ার কথা ৩৫ হাজার টাকা, চাষিদের তা কিনতে হয় দেড় লক্ষ টাকায়। মাথার উপর বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা। সারের বেলাতেও একই ভাবে কালোবাজারিদের অন্যায়ের শিকার হয়ে চলেছেন উত্তরপ্রদেশের চাষিরা।

সৌরভ সিং জানিয়েছেন, জেলার কৃষি দফতরের অফিসাররা নিজেরাই এই কালোবাজারি চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ‘‘এলাকার বিজেপি নেতারা কি আর এ সব জানেন না! তাঁদের আশীর্বাদ না থাকলে কি আর এই কালোবাজারি চলতে পারে’!’– মন্তব্য করেছেন তিনি। তাঁর কথায়– ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যোগীজি লক্ষ্নৌয়ে বসে আছেন। রাজ্যে কী চলছে, সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই। …’’

চাষের জন্য অত্যন্ত দরকারি বিদ্যুতেরও বেহাল দশা ফিরোজাবাদে। সিং জানিয়েছেন, গ্রামে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ১৬ ঘণ্টা করে বিদ্যুতের সরবরাহ থাকে। ফিরোজাবাদে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় বিকেল ৫টা থেকে। অথচ জমিতে জল দেওয়া উচিত দুপুর ৩টের মধ্যে, কারণ এই সময়টায় চড়া গরম থাকায় মাটি ঠাণ্ডা করার দরকার হয়। নিরুপায় হয়ে ভোর ৬টায় জলের পাম্প চালু করেন সৌরভ সিং। এ দিকে দুপুরে পৌঁছে সেই জল গরম হয়ে যায়, ফসলের ক্ষতি হয়। ডবল ইঞ্জিন সরকার নাকি উত্তরপ্রদেশে উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দিয়েছে! এমনটাই তো প্রচার চতুর্দিকে! বাস্তবে সেখানে উন্নয়ন ঠিক কোন জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে, ফিরোজাবাদের চাষিদের দুর্দশার এই ছবি দেখে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

কালোবাজারিদের দাপটে, সরকারের অপদার্থতায় প্রবল ক্ষুব্ধ সৌরভ সিং বলেছেন, ‘‘অসুবিধায় পড়লে আমরা কেউই এলাকার বিজেপি নেতাদের কাছে যাই না। ওঁদের এসব জানিয়ে কোনও লাভ হয় না। বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং, কিংবা মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আমাদের জন্য কিছুই করেননি।’’

ফিরোজাবাদেরই আর এক চাষি হেমন্ত প্রতাপ সিং-ও একই সুরে মন্তব্য করেছেন, বিজেপি সরকার চাষিদের দুর্দশায় কান দেয় না। ২০১৬ সালে তাঁদের গ্রাম থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে এক সভায় এসে মোদিজি হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ‘স্বপ্ন’। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করে দেবে তাঁর সরকার। সে বছরেই একটি সরকারি কমিটি হিসেব করে বলেছিল, প্রতি বছর যদি ১০.৪ শতাংশ করে আয় বাড়ে, তা হলে আগামী ৭ বছরে, অর্থাৎ ‘২২ সালে চাষিদের আয় দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব হবে। এ দিকে ২০২১ সালের সর্বশেষ সমীক্ষার তথ্য বলছে, কৃষি-আয় বৃদ্ধির হার পৌঁছেছে মাত্র ২.৮ শতাংশে।

ফলে দশ বছরের বিজেপি শাসনে দীর্ঘশ্বাস আর উদ্বেগই সম্বল ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়া গোটা দেশের চাষি-সমাজের। প্রচার যাই হোক, ডবল ইঞ্জিন সরকারের উত্তরপ্রদেশও তার একচুল ব্যতিক্রম নয়।

(তথ্য সহায়তাঃ স্ক্রোল ডট ইন, ৫ মে ‘২৪)