এক্সিট পোল-শেয়ার কেলেঙ্কারিঃ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরাজড়িত না থাকলে তদন্তে ভয় কেন

তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর থেকে একের পর এক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠে চলেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। এমনই একটি হল এক্সিট পোল-শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি। অভিযোগ– ভোটের ফল প্রকাশের আগে ভুয়ো এক্সিট পোলে বিজেপি তথা এনডিএ জোটের বিপুল জয় দেখিয়ে শেয়ার বাজারে শেয়ারের দাম চড়ানো হয়েছিল। ফল প্রকাশের পর বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সেই চড়া শেয়ার বাজার ধসে পড়ে। এর ফলে এক দিকে প্রচুর পরিমাণে মুনাফা লোটার সুযোগ পেয়েছে পরিচয় লুকানো কিছু কোম্পানি তথা মালিক, অন্যদিকে বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে শেয়ার বাজারের সঙ্গে যুক্ত সাধারণ মানুষ। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়–এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে নাম জড়িয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

জানা গেছে, ৩১ মে শেষ দফা নির্বাচনের দিন শেয়ার বাজারের কার্যকলাপ আপাতদৃষ্টিতে বিশেষ কোনও কারণ ছাড়াই ব্যাপক ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এনএসই (ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ)-তে সেদিন আগের দিনের তুলনায় দ্বিগুণ মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল, যা সাধারণত ঘটতে দেখা যায় না। কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী সেদিন বিপুল পরিমাণ শেয়ার– মোট বিক্রি হওয়া শেয়ারের ৫৮ শতাংশ– কিনে নিয়েছিল। ঠিক তার পরদিন ১ জুন থেকে সংবাদমাধ্যমগুলি এক্সিট পোল প্রচার করতে শুরু করে। এবারের প্রতিটি এক্সিট পোলেই বিজেপি তথা এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের আগাম ঘোষণা করা হচ্ছিল। এর প্রভাবে সপ্তাহান্তের দু’দিন ছুটির পর ভোটের ফল ঘোষণার আগের দিন ৩ জুন, সোমবার দেখা গেল বাজারে শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্য রকমের চড়া। যে বেনামী বিদেশি কোম্পানিরা ৩১ তারিখ শেয়ার কিনেছিল, তারা চড়া বাজারে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বিপুল মুনাফা করে নেয়। আর আগামী দিনে শেয়ারের দাম আরও বাড়বে এই আশায় সেগুলি দ্রুত কিনে নেয় সাধারণ ক্রেতারা। সেদিন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল বিপুল– ১২.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা। পরদিন ৪ জুন ভোটের ফলাফলের সঙ্গে এক্সিট পোলের ফারাক যখন প্রকট হয়ে উঠল, বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা যত কমতে থাকল, দেখা গেল শেয়ারের দাম ব্যাপক ভাবে পড়ে যেতে শুরু করেছে। বাজারে ধস নেমে ওই দিন অর্থাৎ ৪ জুন ৩০ লক্ষ কোটি টাকা হারান লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। ৩১ মে দেদার শেয়ার কিনেছিল যারা, ততক্ষণে তারা বিপুল মুনাফা লুটে নিয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, কী কারণে ৩১ মে– এই একটি মাত্র দিনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এত শেয়ার কিনেছিল? এর আগে কখনও এমন ঘটনা তো ঘটতে দেখা যায়নি! তবে কি আগে থেকে বিশেষ কিছু বিনিয়োগকারীর কাছে খবর চলে এসেছিল যে পরদিন থেকে এক্সিট পোলগুলি একই সুরে বিজেপির বিপুল জয়ের কথা প্রচার করতে থাকবে এবং তার জেরে শনি-রবি ছুটির পর ৩ জুন বাজার খুললে দেখা যাবে এক ধাক্কায় শেয়ারের দাম রেকর্ড ভাঙা উচ্চতায় পৌঁছেছে? তবে কি কৃত্রিম উপায়ে শেয়ারের দাম চড়িয়ে কিছু বিনিয়োগকারীকে মুনাফা লোটার সুযোগ দিতে প্রতিটি এক্সিট পোলে বিজেপি তথা এনডিএ-র হয়ে মিথ্যা প্রচারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল? এই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কারা– এ প্রশ্নের উত্তরে বলে রাখা ভাল যে, মরিশাসের মতো কর-ফাঁকির স্বর্গরাজ্য থেকে বহু সময়েই বিদেশি মুখোশ পরে ভারতীয় বৃহৎ একচেটিয়া কারবারিরা কাজ চালায়। অবশ্য কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নয়, খুচরো শেয়ার কারবারিদের আড়ালে থাকা দেশেরই বড় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলিই এই ঘটনা থেকে মুনাফা লুটেছে।

এই পরিস্থিতিতে ক্ষতির মুখে পড়া ছোট বিনিয়োগকারীরা দাবি তুলেছেন, সরকারকে এই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আসল পরিচয় প্রকাশ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি)-র কাছে তাঁদের দাবি, কাদের হয়ে কাদের টাকা ৩১ মে তারা শেয়ার বাজারে খাটিয়েছিল, সেই নামগুলি প্রকাশ্যে আনতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ– এক্সিট পোলগুলি একযোগে বিজেপির হয়ে মিথ্যা প্রচার না করলে, শেয়ারের দাম এত চড়ে যেত না এবং ৪ জুন সমস্ত পূর্বানুমান ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁদের এই বিপুল ক্ষতির মুখেও পড়তে হত না। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, কাদের স্বার্থে এ হেন এক্সিট পোলের ভুয়ো প্রচার হল? ছোট বিনিয়োগকারীদের রেকর্ড পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নামে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যবসায়ীদের বিপুল মুনাফা লোটার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কেলেঙ্কারির উপযুক্ত তদন্ত চাইছেন তাঁরা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই এক্সিট পোল-শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিজেপির আরও কয়েকজন বড় নেতার যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। লোকসভা ভোট চলাকালীন ১৩ মে মোদি ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট আদানি সাহেবের মালিকানাধীন এনডিটিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘‘৪ জুনের আগে আপনাদের শেয়ার কিনে রাখার পরামর্শ দিচ্ছি, কারণ তার পরে শেয়ারের দাম বাড়বে।’’ এর পর ১৯ মে ওই একই টিভি চ্যানেলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন– ৪ জুন শেয়ার বাজার সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে। অর্থাৎ বিজেপি সরকারের দুই প্রধান কর্তা দেশের মানুষকে খোলাখুলি শেয়ার কেনার আহ্বান জানিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন, ভোটের ফল প্রকাশের পর তাঁরা লাভ করার সুযোগ পাবেন! আজ পর্যন্ত সরকারে আসীন কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে এ ধরনের কথা শোনা যায়নি, যাওয়ার কথাও নয়। কারণ, শেয়ার বাজার নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার কাজ তাঁদের এক্তিয়ারে পড়ে না। ফলে সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, তাহলে কি এক্সিট পোলে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিজেপির জয় নিয়ে মিথ্যা প্রচারের ষড়যন্ত্র হয়েছিল যাতে শেয়ার বাজার চড়ে গিয়ে কিছু বিশেষ বিনিয়োগকারীর দেদার মুনাফা হয়! তাতে ছোট কিছু বিনিয়োগকারীকে না হয় ক্ষতির শিকার হতে হল! এ ধরনের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ তো হয়েই থাকে!

এ কথা ঠিক,পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দিনে দিনে যত বেশি সংকটগ্রস্ত মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে, শেয়ার বাজারে ফাটকা কারবারের ততই রমরমা হচ্ছে। দুনিয়া জুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাজের সুযোগ কমার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল ভাবে কমছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। উৎপাদিত পণ্য গুদামে পচতে থাকায় উৎপাদন ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগে পুঁজিপতিদের উৎসাহ যত কমছে, ততই তারা পুঁজি বিনিয়োগের মরিয়া চেষ্টায় আরও বেশি করে শেয়ার বাজারকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, নানা কৌশলে তা থেকে মুনাফা লুটতে চাইছে। কিন্তু শেয়ার দরের এবারের এই নজিরবিহীন ওঠানামা তো সেই সাধারণ প্রক্রিয়ায় ঘটেনি। এর মধ্যে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ– সকলের মনেই জাগছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করে সত্য উদঘাটন করা। তা না হলে ষড়যন্ত্রের অংশীদার ও প্রতারক হিসাবে তাঁদের সম্পর্কে দেশবাসীর সন্দেহ ঘুচবে না।(সূত্রঃ ডেকান হেরাল্ড-৯ জুন, দ্য ওয়্যার ৯ ও ১০ জুন, স্ক্রোল ডট ইন-৭ জুন ও আদানি ওয়াচ-১৯ জুন ২০২৪)