ট্যাংরা, বেহালা, মধ্যমগ্রাম, হালতু– দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই কোথায় নয়! গোটা পরিবারের একত্রে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কোথাও মা-মেয়ের, কোথাও বাবা-ছেলের দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা, কোথাও গোটা পরিবারের সব সদস্যের আত্মহত্যা বা একত্রে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত– একের পর এক ঘটনায় মানুষের বিপন্নতা ফুটে উঠছে। পরিবারের বাকি সদস্যরা তো বটেই, সংবাদমাধ্যমে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে যে কোনও সংবেদনশীল মানুষ বাক্যহারা হয়ে যাচ্ছেন। এ শুধু এক বা একাধিক পরিবারে বিপর্যয় তৈরি করছে তাই নয়, সমাজমননে প্রচণ্ড উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে– এই পরিণতি কি ঘটতেই থাকবে?
আপাত অর্থে এর কারণ পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক অসচ্ছলতা, প্রচুর দেনা, সন্তানের অসুখ নিয়ে দুশ্চিন্তা হলেও এর উৎস সমাজের অনেক গভীরে। কাজের অনিশ্চয়তা, স্বল্প রোজগার, জীবনধারণের ব্যয়বৃদ্ধিতে নিরূপায় অবস্থা বহু পরিবারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তুলনায় সচ্ছ্বল পরিবারেও সংকট কম নয়। একদিকে ছোট ব্যবসা, ছোট শিল্পে সংকট থেকে বাড়ছে ঋণের বোঝা। আবার কোনও ক্ষেত্রে ভোগবাদের শিকার হয়ে সাধ্যের বাইরে বিলাসবহুল জীবন কাটানোর জন্য প্রচুর ধার-দেনার ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেকে। শোধের উপায় খুঁজে না পেয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
এই সমাজের সবচেয়ে বড় অসুখ হল আত্মকেন্দ্রিকতা, নিজেকে নিয়ে থাকা। আজকের সমাজ মানে সংকটগ্রস্ত বুর্জোয়া সমাজ। এর সংকটের প্রভাবে আত্মীয়-পরিজন-প্রতিবেশী তো অনেক দূরের বিষয়, নিজের পরিবারের সদস্যরাও কেউ কারও নয়! এই ব্যবস্থা প্রত্যেকটি মানুষকে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলতে চায়। ফলে একের দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না, মনে লালন করা ভাবনা, দুঃখ-যন্ত্রণার বিনিময় হচ্ছে না কারও সঙ্গে। শরীরে-মনে জর্জরিত হয়ে সমস্যা সমাধানের কোনও পথ না পেয়ে একদিন সেই যন্ত্রণার দুঃখজনক পরিণতি ঘটছে। বাস্তবে মানুষে মানুষে আজ মনের দূরত্ব এতটাই যে, মর্মান্তিক কোনও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নিকটাত্মীয় বা পাশের বাড়ির বাসিন্দারা হয়ত সেই পরিবারগুলি সম্পর্কে জানতে পারছেন।
বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এই একাকীত্ব, অসহায়তা। পুঁজিবাদের সার্বিক সংকটের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই সামাজিক অসুখ। সমাজ অভ্যন্তরে এমন পরিবেশ যদি থাকত, যে এই অসহায় দুঃখী মানুষগুলি কারোর কাছে মন খুলে কথা বলতে পারত, একে অপরকে বুঝতে পারত, অন্যের সমব্যথী হয়ে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হত, যদি কোনও উপায় বের করা না-ও যেত, তা হলেও মন কিছুটা হালকা হত, একা এই ভারী বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হত না। তা হলে হয়ত এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার সংখ্যা কিছুটা হলেও কম হত। অসহ ঋণের বোঝা হালকা করে বা পরিজনের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় সুলভ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিপর্যস্ত মানুষের জন্য বাঁচার উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারত প্রশাসন, সরকার– সেটাও অনুপস্থিত।
ফলে সামাজিক এই সংকটকে মোকাবিলা করতে হলে একদিকে দরকার মানুষে-মানুষে পারস্পরিক সংযোগ, অন্যদিকে দরকার রোজগারহীন বা ঋণগ্রস্ত এই অসহায় পরিবারগুলির সাহায্যে সরকারের এগিয়ে আসা। সর্বোপরি যে সমাজ এই অসুস্থ মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে, দরকার তার পাল্টা সুস্থ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা, যেখানে ব্যক্তিগত চিন্তার বাইরে সমষ্টিগত ভাল-মন্দও মানুষকে ভাবাবে। ‘সকলে আমরা সকলের তরে, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই প্রবাদবাক্যটি কিছুটা হলেও বাস্তবে রূপ পাবে। না হলে এই মর্মান্তিক ঘটনার সংখ্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না।