বাবুদা পাড়ায় সক্রিয় সিপিএম কর্মী বলে পরিচিত। ভাল নাম একটা কিছু হয়ত আছে, তবে ডাক নামেই সবাই চেনেন। সেদিন চায়ের দোকানে তাঁকে দেখে বললাম,কী বাবুদা,খবর কী? কাজকর্ম কেমন চলছে?
বললেন,দাঁড়ান দাঁড়ান,আগে এদের সরাই। তার পরে অন্য কাজ।
বললাম,কাকে সরাবেন?
আরে,যারা ক্ষমতায় আছে।
তা সরাবেন তো বটে! কিন্ত বদলে কাকে নিয়ে আসবেন? আপনাদের তো আর আসার কোনও চান্স নেই।
বললেন,এবার রাম।
বললাম,সে কী! বাম হয়ে রামকে নিয়ে আসবেন? তা ছাড়া তারা কি আরও খারাপ নয়?
বাবুদা,খানিকটা যেন ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,না,না,এত খারাপ সরকার এর আগে আসেনি। এদের সরাতেই হবে।
কিন্তু যাদের কথা বলছেন তারা তো আরও খারাপ।
বললেন,দেখি না পাঁচটা বছর। মানুষ ওদের দেখে নিলে তারপর তো আমরাই আবার ফিরে আসব।
বললাম,নতুন করে কী দেখবেন? এরা তো নতুন দল নয় যে নতুন করে দেখতে হবে! এ রাজ্যে না দেখলেও কেন্দ্রে সাত বছর ধরে দেখছেন। উত্তরপ্রদেশে দেখছেন, ত্রিপুরায় দেখছেন। সব মিলিয়ে ১৬টি রাজ্যে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। কেন্দ্রের কিংবা ওইসব রাজ্যগুলোর দিকে একটু তাকালেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিষ কত খারাপ তা তো খেয়ে দেখাটা বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়।
বললেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ বার এ রাজ্যে আসল পরিবর্তন হবে।
বললাম, কেমন পরিবর্তন হবে তার টাটকা সাক্ষী তো ত্রিপুরা। আপনাদেরই তো পলিটবুরো নেতা মানিক সরকার। তিনি তো সাবধান করেছেন, এবার আর কেউ যেন রামে ভোট না দেয়। ত্রিপুরাতেও নাকি এখানকার মতোই বিজেপি নেতাদের আসল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিতে ভুলে সিপিএম সমর্থকরা রামে ভোট দিয়েছিল। আর এখন সরকারে বসে বিজেপি বিরোধীদের কথাই বলতে দিচ্ছে না। যে কোনও প্রতিবাদকেই পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে গায়ের জোরে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। ঘোষণা করেছে, কোনও চাকরিই আর স্থায়ী থাকবে না। সরকারি সব চাকরিই হবে চুক্তির ভিত্তিতে। তাদের বেতনও হবে সরকারি কর্মচারীদের বেতনের ভগ্নাংশ মাত্র।
বাবুদা বললেন, ত্রিপুরার কথা আলাদা। এখানে কোনও নেতা কি ও কথা বলছেন?
বললাম, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথায় আপনার এতখানি বিশ্বাসের কারণ কী? এর আগের নির্বাচনগুলিতে তাঁরা এমনই যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলি কি পূরণ করেছেন? গ্যাস কেরোসিন জ্বালানি তেল সব কিছুর দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে তো কেন্দ্রের বিজেপি শাসনেই ঘটেছে। সব সরকারি সম্পত্তি তো জলের দামে এরাই পুঁজিপতিদের কাছে বেচে দিচ্চে। রেল বেসরকারি হাতে দিয়ে দিচ্ছে। ভাড়া বাড়াচ্ছে লাফিয়ে। এর বোঝা তো আপনার উপরেও পড়ছে।
বললেন, লকডাউনের কারণে কিছুটা দাম বেড়েছে বটে, তবে করোনা চলে গেলেই আবার কমে যাবে।
বললাম, এ সব কথা তো বিজেপির নেতারা বলছেন। আপনি তো তাঁদের কথাগুলোই বলছেন। আপনার তো উচিত কথাগুলো যাচাই করে নেওয়া।
বললাম, আপনারা যা করছেন তার দ্বারা তো বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক দলেরই শক্তিবৃদ্ধি করা হবে। যে বিজেপির কোনও সাংসদ ছিল না, আপনাদের কল্যাণে গত লোকসভা ভোটে তারা ১৮টা সাংসদ পেয়ে গেল, আর আপনারা শূন্য হয়ে গেলেন।
বাবুদা বললেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে দেখবেন, তৃণমূলের সব নেতারা গিয়ে বিজেপিতে ভিড়বে। তখন আর তৃণমূল বলে কিছু থাকবে না। তখন আমরাই হব একমাত্র বিরোধী দল। মানুষ তখন আমাদেরই সমর্থন করবে।
বললাম, কিন্তু এই আমরাটা কারা? আপনি তো ইতিমধ্যেই বিজেপি হয়ে গেছেন। আপনার চিন্তার পদ্ধতিটাই তো আপনাদের নেতারা ইতিমধ্যেই পাল্টে দিয়েছেন। বিজেপির করা যুক্তিগুলোই বিজেপির মতো করে আওড়াচ্ছেন। আপনাদের যে নেতারা ‘আগে রাম পরে বামে’র স্লোগান তুলেছিলেন এবং এখনও কখনও প্রকাশ্যে, কখনও আড়ালে আওড়াচ্ছেন তাঁদেরই কি আর বামত্ব কিছু আছে!
বাবুদা বললেন, দলে এই নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় ফিরতে গেলে এ ছাড়া যে আর কোনও রাস্তা নেই!
বললাম, ক্ষমতায় ফেরার জন্য বামপন্থীরা কি যে কোনও রাস্তা নিতে পারে? তা হলে তো বামপন্থাকেই বিসর্জন দেওয়া হয়। বললাম, আপনাদের নেতাদের এই ভাবনার সাথে বামপন্থা দূরের কথা গণতান্ত্রিক ভাবনারও কোনও সম্পর্ক নেই। যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো স্বাধীনতার পর কোনও দিন এ রাজ্যে জায়গা করতে পারেনি, তাকেই আপনাদের নেতাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এ রাজ্যে জায়গা করে দিল।
বললাম, আপনাদের নেতারা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে দলের মধ্যে বামপন্থার আর অবশিষ্ট কিছু রাখেননি। না হলে, যদি এটা ছয়ের দশকের ঘটনা হত, যদি সেদিন নেতারা এমন করে কর্মীদের দক্ষিণপন্থী দলে ভোট দিতে বলতেন, তবে দলে তীব্র প্রতিবাদ উঠত। নেতারা সমালোচনায় বিদ্ধ হতেন।
বাবুদা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, দেখুন, আমি কিন্তু এই স্লোগানটা প্রথম শোনার পরে প্রতিবাদ করেছিলাম। বলেছিলাম, বামপন্থী হিসাবে এটা আমরা করতে পারি না। কিন্তু নেতারা বললেন, ক্ষমতাতেই যদি না থাকতে পারি তবে বামপন্থা কী কাজে লাগবে? তার উত্তর করতে পারিনি।
আমি বললাম, বাবুদা, আপনি তো বলবেনই। আপনি তো আসলে বামপন্থী। কিন্তু দেখুন, নেতৃত্ব আপনার মতো এমন অসংখ্য বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের কী ভাবে শুধুমাত্র গদির লোভে ভুল বোঝাচ্ছে। এই সর্বনাশের রাস্তা থেকে আপনাদের ফিরে আসতে হবে। বামপন্থীদের উপরই যে সমাজের ভবিষ্যত নির্ভর করছে।
বাবুদা দু কাপ চা দিতে বলে বললেন চায়ের দামটা কিন্তু আমি দেব।