১) আইনটি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার আগে দেশের সমস্ত কৃষক সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা হয়নি। অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
২) কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উল্লেখ নেই।
৩) মজুতদারিকে আইনসম্মত করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে মজুতদার-কালোবাজারিরা দাম বাড়াবে।
৪) কোনও পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হলেও সরকার হস্তক্ষেপ করবে না।
৫) চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনও প্রভাব থাকবে না। কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছেমতো চলবে।
৬) দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকা নেই। অ্যাপিলেট অথরিটির নিচের স্তরে থাকবেন মহকুমা শাসক, তার উপর থাকবেন জেলাশাসক।
৭) কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলাশাসক ও মহকুমা শাসকদের, রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক।
৮) নিরক্ষর, প্রায় নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত চাষির পক্ষে তো বটেই, উচ্চশিক্ষিত আইনজ্ঞ নন, এমন মানুষের পক্ষেও চুক্তি মুসাবিদা করা, চুক্তিতে উল্লিখিত শর্ত ও ধারাগুলি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সংস্থার পক্ষে আইনজ্ঞ নিয়োগ সম্ভব। কিন্তু চাষির সেই সাহায্য প্রয়োজন হলেও সামর্থ্যে কুলোবে না। ফলে চুক্তিচাষজনিত বিবাদের মীমাংসায় চাষিরা ন্যায় বিচার পাবে না।
৯) ভারতে কৃষি এখনও অনেকাংশে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বন্যা, খরা, কীটের উৎপাত কিংবা পতঙ্গের হামলায় ফসল যদি মাঠেই নষ্ট হয়, তখন কৃষককে চুক্তিভঙ্গকারী বলার সম্ভাবনা থাকছে।
১০) বিচারে চুক্তিভঙ্গকারী সাব্যস্ত হলে ফসল হারানো কৃষক ক্ষতিপূরণ দেবে কোথা থেকে?
১১) চাষি ও ক্রেতা সংস্থা উভয়ের তরফেই বিমা প্রয়োজন হবে। এইসব বাবদ ব্যয় হবে যেমন বাণিজ্যিক ক্রেতার, তেমনই চাষির। এই ব্যয় নিশ্চয়ই ফসলের দামে যুক্ত হবে এবং বাজারে ফসলের দাম বাড়াবে।
১২) চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে বিচারে আইনজ্ঞের সাহায্য লাগবে। অর্থবলে বলীয়ান বাণিজ্যিক সংস্থা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। ফলে চাষি ন্যায় বিচার পাবে না।
১৩) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি ৮৬ শতাংশ। তাদের হাতে জমি ৪৭ শতাংশ। ১৪ শতাংশ চাষির হাতে আছে বাকি ৫৩ শতাংশ জমি। এই ৮৬ শতাংশ চাষি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক এবং এঁরাই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এঁদের কী পরিণতি হবে?
১৪) যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি এবং মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই সরকার মজুতদারি এবং দাম নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করবে বলেছে। আজ মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক হলেও হস্তক্ষেপ করছে কোথায়?
১৫) স্বয়ং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী করোনার তাণ্ডবকে আখ্যা দিয়েছেন ‘দৈব দুর্বিপাক’। এটা কি অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়?
১৬) আইনের কোনও না কোনও ফাঁকে ঋণগ্রস্ত অসহায় কৃষকের জমি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলিও কুক্ষিগত করবে।
১৭) এই আইনের ফলে ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়বে। মুষ্টিমেয়ের জোতের পরিমাণ বাড়বে। অসংখ্য ছোট চাষির সঙ্গে চুক্তি করার চেয়ে অল্প সংখ্যক বড় চাষির সঙ্গে চুক্তি করলে পরিশ্রম কমে, খরচ কমে, মুনাফা বাড়ে। আইন কর্পোরেটদের সেই সুবিধা করে দেবে।
১৮) ভারতে কৃষি উৎপাদন উদ্বৃত্ত। তা সত্তে্বও দেশে এখনও সাতাশ কোটি ক্ষুধার্ত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ক্ষুধা সমস্যার সমাধানে ১১৭ দেশের মধ্যে ভারত ১০৩ নম্বর দেশ। উদ্বৃত্ত শস্য ক্ষুধা-সমস্যা সমাধানে ব্যবহারের কোনও দিশা নেই।
১৯) দেশে মাথাপিছু খাদ্যশস্যপ্রাপ্তির নিরিখে ১৯৪৮ সালের তুলনায় বর্তমানে কোনও অগ্রগতি ঘটেনি, বরং ১৯৯১ সালের তুলনায় মাথাপিছু খাদ্যশস্যপ্রাপ্তি কমেছে।
২০) সাধারণ মানুষের পুষ্টির তিন-চতুর্থাংশ আসে চাল-গম-বাজরা ইত্যাদি খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন ডাল থেকে। সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইনে আর অত্যাবশ্যক নয়।
(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১২ সংখ্যা_১১ ডিসেম্বর, ২০২০)