একচেটিয়া মালিকদের লুঠের স্বার্থে কোপ মোবাইল গ্রাহকদের ঘাড়ে

দার্জিলিং

সম্প্রতি মোবাইল ফোনের ভয়েস এবং ইন্টারনেট উভয় ক্ষেত্রে ব্যাপক মাশুল বৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে প্রবল চাপে ফেলেছে। ১৯৯৫ সালে শুরু হয়ে মোবাইল পরিষেবা টু-জি, থ্রি-জি, ফোর জি, হয়ে এখন ফাইভ জি পরিষেবার দোরগোড়ায়। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে মোবাইলের ব্যবহারেও পরিবর্তন হয়েছে। এখন শুধু কথা বলাই নয়, নানা ধরনের বার্তা, ছবি, ভিডিও ইত্যাদির দেওয়া-নেওয়া, প্রশাসনিক ও ব্যাঙ্কের কাজ, সমাজ মাধ্যমের যোগাযোগে মোবাইল অপরিহার্য। গ্রাম-শহরের নিম্নবিত্ত-গরিব মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা সহ নানা দিকে এর ব্যবহার বহুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। যে ভাবে ভারত সরকার ডিজিটাল ইন্ডিয়া, পেপারলেস ইন্ডিয়ার কথা বলছে তাতে আগামী দিনে মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার আরও বাড়বে। ফলে মোবাইল আজ উচ্চবিত্তের বিলাসের উপকরণ নয়, সাধারণ মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিষেবা।

বিশ্বায়নের বিষবৃক্ষ

আজ ভারতের টেলিকম ক্ষেত্রটি কার্যত বেসরকারি একচেটিয়া মালিকদের কুক্ষিগত। খনি, ভারিশিল্প, রেল, ডাক, বিদ্যুৎ, টেলিকম সহ যে ক্ষেত্রগুলিতে প্রচুর বিনিয়োগ লাগে, স্বাধীনতার পর ভারত সরকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দিতে জনগণের টাকায় সেগুলি গড়ে তুলেছে। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের আর্থিক নীতি গৃহীত হলে এই ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়া শুরু হয়। সুকৌশলে প্রশ্ন তোলা হল সরকার কেন ব্যবসা করবে? বলা হল এর ফলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে দাম খুশি মতো বাড়বে না। এর জন্য নেওয়া হল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সরকারি ক্ষেত্রে পরিষেবার মান নামিয়ে দাও, প্রয়োজনে অন্তর্ঘাত করে লাভজনক সরকারি সংস্থাগুলিকে লোকসানের দিকে নিয়ে যাও, যাতে সেগুলি অতি সহজেই বেসরকারি লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। টেলিকম পরিষেবার ক্ষেত্রেও সরকার এই নীতি নিয়ে চলছে।

বিএসএনএলকে খতম করার পরিকল্পনা

১৯৯৫ সালেবেসরকারি কোম্পানিগুলিকে মোবাইল পরিষেবার লাইসেন্স দেওয়া হলেও ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকম (ডিওটি)-কে সরকার মোবাইল পরিষেবার অনুমতি দেয়নি। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে অটলবিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার টেলিগ্রাম মন্ত্রক থেকে বাইরে এনে তৈরি করে ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড বা বিএসএনএল। কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল বিএসএনএল-এর আর্থিক স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করা হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ঠিক এর বিপরীত। সরকারি টেলিকম নীতিতে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হলেও ২০০২ সালে মোবাইল পরিষেবা চালু হওয়ার সাত বছর বাদে বিএসএনএল-কে এই ক্ষেত্রে ব্যবসা করার লাইসেন্স দেওয়া হল। বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলো মেট্রো ও বড় শহরে ব্যবসা করলেও প্রত্যন্ত এলাকায় টু জি, থ্রি জি পরিষেবা ছড়িয়ে দিতে গেলে বিএসএনএল-কে প্রয়োজন। তাই সাত বছর বাদে বিএসএনএল-কে সুযোগ দেওয়া। এই সাত বছরে সরকারি সহযোগিতায় শিল্পপতি অনিল আম্বানির রিলায়েন্স কমিউনিকেশন সহ বেসরকারি মালিকরা শুধুমাত্র হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করল তাই নয় এই পরিষেবার বাজার অনেকটা দখল করার দৌড়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল। কিন্তু যন্ত্রাংশের আধুনিকীকরণের জন্য বিএসএনএল সরকারের কাছে বারবার আবেদন করলেও তা বাতিল করে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিএনবিসি টিভি-১৮ কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশংকর নিজেই বলেন, সরকার চায়নি বলেই সরকারি কোম্পানি বরাত পায়নি।

ফোর-জি স্পেকট্রাম নিলামেও ব্রাত্য বিএসএনএল

ভারতের টেলিকম জগতের ছবিটা পাল্টে গেল মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিও-র আগমনের পর। ২০১৬-র অক্টোবরে ফোর-জি স্পেকট্রামের নিলামে সরকারেরই পরিকল্পনামাফিক বিএসএনএল-কে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোন স্পেকট্রাম পেয়ে গেল। রিলায়েন্স জিও-র ফোর-জির বিজ্ঞাপনে ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। ফোর জি পরিষেবায় বিএসএনএল-কে প্রবেশ করতে না দিয়ে জিও সহ কর্পোরেট মোবাইল অপারেটরদের সহজেই দেশের মোবাইল বাজার করায়ত্ত করানোর জন্যই যে এই পরিকল্পনা, তা বুঝতে টেলিকম বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

এবার নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে শুরু হল টেলিকম ক্ষেত্রে একচেটিয়াকরণের পরিকল্পনা। পরিষেবা শুরু করার দিন থেকে মুকেশ আম্বানির জিও আগ্রাসী রূপ নিয়ে ব্যবসা শুরু করল, যার উদ্দেশ্য অন্য প্রতিযোগীদের বাজার থেকে সরিয়ে দিয়ে একাধিপত্য স্থাপন করা। এক্ষেত্রে জিও আইন ভাঙলেও সরকার কিছুই করেনি।

ট্রাইকাঠের পুতুল

এই বেআইনি কাজে যাদের হস্তক্ষেপ করার কথা সেই টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (ট্রাই) সম্পূর্ণ নীরব। তৎকালীন টেলিকম সেক্রেটারি জে এস দীপক এতে আপত্তি করলে সরকার তাঁকে সরিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় জিও-র স্বার্থে সরকার ট্রাইকে দিয়ে ‘প্রিডেটর প্রাইসিং’-এর সংজ্ঞা পাল্টে দেয়। ২০১৭ সালে জিও গ্রাহক কম ছিল। ফলে জিও-র নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে কলের সংখ্যা ছিল প্রচুর। তাই জিও-কে অন্য প্রতিযোগী কোম্পানিগুলিকে ‘ইন্টারকানেক্ট ইউসেজ চার্জ’ (আইইউসি) বাবদ বেশি টাকা দিতে হত। শুধুমাত্র জিও-কে সাহায্য করার জন্য ট্রাই আইইউসি চার্জ ৫৭ শতাংশ কমিয়ে দেয়, ফলে জিও প্রচুর লাভবান হয়।

খাতায় কলমে ট্রাইয়ের কাজ হল দাম নির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন, কোম্পানিগুলো আইন মানছে কি না, তা দেখা। সর্বোপরি গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা করা। এর অফিসার থেকে কর্মচারী সবাইকেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা নিযুক্ত। সরকার না চাইলে এই সংস্থা কর্পোরেটের স্বার্থে আইন পরিবর্তন করতে বা কর্পোরেটকে বেআইনি কাজ করতে দিতে পারে কি? এক দিকে অন্তর্ঘাত করে বিএসএনএল-কে ক্রমাগত সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া অন্যদিকে বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রতিযোগী কোম্পানির সংখ্যা কমিয়ে একচেটিয়াকরণ এটাই ছিল সরকারি পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা রূপায়নে সরকার ট্রাইকে কাজে লাগাল। সরকারের পরিকল্পনা আগামী দিনে ব্যাপক ডিজিটালাইজেশন, অনলাইন শিক্ষা, পেপারলেস ওয়ার্ক সহ নানা কাজে মোবাইলের ব্যবহার বাড়ানো। এমন একটা সময় এই বিষয়গুলো আনা হচ্ছে যখন তিনটে টেলিকম কোম্পানি ছাড়া গ্রাহকদের কাছে বিকল্প কিছু নেই। আসলে আত্মনির্ভর নয়, কর্পোরেট নির্ভর ভারত গড়ে তোলাই সরকারের মূল লক্ষ্য।

দাম বাড়াতে ক্ষতির ভুয়া তত্ত্ব

কিছুদিন আগে প্রথমে এয়ারটেল তারপর ভোডাফোন ও জিও রিচার্জ ও নেট প্যাকেজে ট্যারিফ মূল্য কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ বাড়িয়েছে, অজুহাত লোকসান এবং বকেয়া রাজস্ব। তাই দাম না বাড়িয়ে নাকি উপায় নেই। ২০১৯ সালে কোম্পানিগুলো চল্লিশ শতাংশ দামবৃদ্ধির সময়ও একই কথা বলেছিল এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রিলিফ প্যাকেজ আদায় করেছিল। এবারও তারা একই ভাবে সরকারের থেকে রিলিফ প্যাকেজ আদায় করেছে, একইসাথে মাশুলও বাড়িয়ে নিয়েছে। এইভাবে তারা দুদিক থেকে লাভ করছে।

সত্যিই কি মোবাইল কোম্পানিগুলির লোকসান হচ্ছে? ভারত সরকারের হিসাব পরীক্ষক সংস্থা সিএজি তার রিপোর্টে বলেছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ এই পাঁচ বছরে এয়ারটেল, ভোডাফোন, রিলায়েন্স সহবেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলো ৬১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা আয় কম দেখিয়েছে, এর ফলে সরকারের ১২ হাজার ২২৯.২৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে (ইকনমিক টাইমস, ২২-০৭-২০১৭)। এর আগেও সিএজি রিলায়েন্স ইনডাসট্রির ইনফোটেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল যে দ্রুত গতির ইন্টারনেট স্পেক ট্রামের নিলামে তারা জালিয়াতি করেছে। সিএজি দেশব্যাপী জিও-র এই স্পেকট্রামের লাইসেন্স বাতিলের কথা বলে। সরকার কিছুই করেনি। বর্তমান আর্থিক বছরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কোয়ার্টারে জিও লাভ করেছে যথাক্রমে ৩ হাজার ৭২৮ ও ৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা, যা গত আর্থিক বছরের থেকে অনেক বেশি। কোথায় লোকসান? প্রতিদিন মোবাইল কোম্পানিগুলি আয় করে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এবার যে মাশুল বাড়ল তার ফলে কোম্পানিগুলির ৪০ শতাংশ আয় বাড়বে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে তাদের আয় ৭২ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লক্ষ কোটি টাকা বেড়ে যাবে। এবারের মূল্যবৃদ্ধির পর মোবাইল কোম্পানিগুলির গ্রাহক পিছু আয় হয়েছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। তাদের লক্ষ্য এটাকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় নিয়ে যাওয়া।

প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ গ্রাহক আন্দোলন

ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম ব্যবসার কেন্দ্র। বর্তমানে দেশে মোবাইল ব্যবহারকারী প্রায় ১১৮ কোটি, এর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন প্রায় ৬০ কোটি মানুষ, ইন্টারনেট ব্যবহার করেন প্রায় ৭০ কোটি মানুষ। ক্রমবর্ধমান আর্থিক মন্দায় দেশে ৮৪ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে পথে বসেছে কোটি কোটি মানুষ, যারা কাজ করছে তাদের বেতনে কোপ পড়েছে। জীবন-জীবিকার নানা প্রয়োজনে এখন গরিব মানুষকেও অনেক বেশি পরিমাণে মোবাইল ওনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বহুল পরিমাণে বেড়েছে। এই অবস্থায় বারে বারে এত ব্যাপক মাশুল বৃদ্ধি কেন? যারা পড়াশোনা সহ বেঁচে থাকার নানা প্রয়োজনে মোবাইল ও নেট ব্যবহার করে, আর কর্পোরেট ব্যবসায়ী যারা ব্যবসার প্রয়োজনে এই পরিষেবা ব্যবহার করে এই দুই ক্ষেত্রে দাম এক হতে পারে কি? তাছাড়া মোবাইল কোম্পানিগুলি ২৮ দিনে মাস ধরায় তাদের বছর ১২ মাসের বদলে ১৩ মাসে হয়। এভাবে গ্রাহক পিছু এক মাসের টাকা তারা অতিরিক্ত আয় করে, যা অনায্য।

এই রকম এক পরিস্থিতিতে যেখানে সরকার এবং ট্রাই কর্পোরেট মোবাইল কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যস্ত সেই অবস্থায় অসহায় গ্রাহকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। গ্রাহক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য গত ১৯ জানুয়ারি অনলাইন কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে ‘মোবাইল ইউজারস ফোরাম’। কর্পোরেট মোবাইল কোম্পানিগুলির মুনাফা-লালসার বিরুদ্ধে এবং সরকারের কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ও বিএসএনএল-কে অন্তর্ঘাত করে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সচেতন সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আবেদন জানিয়েছে ফোরাম।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৬ সংখ্যা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২