অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে দেশে তৃতীয় দফায় মোট প্রার্থীদের মধ্যে ২৯ শতাংশ কোটিপতি। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকশন ওয়াচ’ ও ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিসার্চ’ (এডিআর)-এর প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে। প্রতি দফাতেই এ রকম প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। তৃতীয় দফায় দেশের ১২টি রাজ্যের ৯৫টি আসনের ১৩৫২ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৯২ জনই কোটিপতি।চমকে উঠবেন না! গতবারের সাংসদদের সম্পদের পরিমাণের সাথে বড়জোর তুলনা করতে পারেন।গত লোকসভার ৫৪৩ জন সাংসদের ৪৭৫ জনই ছিলেন কোটিপতি। সাংসদদের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় একুশ কোটি টাকা। (আনন্দবাজার পত্রিকা -১০ মে)
এ রাজ্যে আসানসোল কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহার ঘোষিত সম্পত্তি ১৩২ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা, মেদিনীপুর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পালের ঘোষিত সম্পত্তি ৪ কোটি ১৯ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকার বেশি। ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী জুন মালিয়ার ঘোষিত সম্পত্তি ৩ কোটি ৩৫ লক্ষ ১৬ হাজারের বেশি। মুর্শিদাবাদের তৃণমূল প্রার্থীর গত বারের থেকে সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৩৩১ শতাংশ, মালদহ উত্তরের বিজেপি প্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। এই দলগুলি এবং তার প্রার্থীরা নির্বাচনে জিততে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে।
২০২৩-এ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের লজ্জাজনক স্থান ১১১। দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যখন হু হু করে বাড়ছে, সবচেয়ে কম ওজনের, রুগ্ন-অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায়় দেশ যখন গোটা বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করেছে, স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত, চাকরির সঙ্কট ভয়াবহ, অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র– সেই সময় নির্বাচনে বিপুল খরচ বড়ই বেমানান। দেশের এই সঙ্কটের চিত্র সামনে থাকলে, জনগণের এই দুর্দশা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত হলে কোনও জনপ্রতিনিধি এ ভাবে স্রোতের মতো টাকা ঢালতে পারেন না। কিন্তু শাসক দলগুলির অতি ধনী হবু সাংসদরা জেতার লক্ষ্যে টাকার স্রোত বইয়ে দিতে দ্বিধা করছেন না।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে দেশের ৫০ ভাগ মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৩ ভাগ রয়েছে সেখানে দেশের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিদের সাড়ে সাতাশি শতাংশ কোটিপতি হয় কী করে? হলে তাঁদের কি এই মানুষদের প্রতিনিধি বলা যায়?
সাংসদদের অনেকেই বলে থাকেন, তাদের একমাত্র পেশা রাজনীতি। তাঁদের ভাষায় সমাজসেবা! তা হলে তাঁরা এত বিপুল সম্পদের অধিকারী হচ্ছেন কী ভাবে? নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি দেখিয়ে দিয়েছে পুঁজিপতিদের দানেই এই দলগুলির সিন্দুক ভরছে।শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের বেআইনি নানা কাজ, অন্যায় এবং দুর্নীতিকে আড়াল করতে তাঁরা শাসক দলগুলি এবং তার নেতা তথা সাংসদদের দ্বারস্থ হন। তারা দু’হাত ভরে দেন সাংসদদের। এদেরই কল্যাণে অবাধে বেআইনি লটারি চলে, বিদ্যুৎ-ওষুধের দাম বাড়ে, সরকারি বরাত হস্তগত হয়, বিনিময়ে দল এবং নেতাদের পকেট ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এ ভাবে দুর্নীতি সংসদীয় ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।
এই দুর্নীতির টাকাই দেদার খরচ হয় নির্বাচনে।এই টাকা দিয়েই তারা বেকার যুবকদের কেনে। নির্বাচনে রিগিং করতে, ছাপ্পা ভোট দিতে, প্রতিপক্ষকে শাসানি দিতে এদের কাজে লাগায়। এই টাকা খরচ করেই টিভিতে-খবরের কাগজে-সমাজমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়।
সংসদের অভ্যন্তরে সম্পদশালীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সঙ্কুচিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের পরিসর। সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলার লোক, তাদের জন্য নীতি-নির্ধারণের লোক সংসদের ভেতরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ধনী সাংসদরা শ্রেণিগত কারণেই গরিব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না।বিলাস-বৈভবে দিন কাটানো এই ‘জনপ্রতিনিধিদের’ পক্ষে গরিবের দুঃখ-ব্যথা অনুভব করা সম্ভব নয়।ছাঁটাই শ্রমিক কিংবা খেতমজুর পরিবারের জীবন কেমন করে কাটে তার খবর রাখা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
স্বভাবতই সম্পদশালী সাংসদদের পৃষ্ঠপোষক পুঁজি মালিকদের স্বার্থে দেশের নীতি নির্ধারণ হবে, এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দস্তুর হয়ে উঠেছে। এই সাংসদরা পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে জনস্বার্থবিরোধী নীতি-আইন পাশ করাচ্ছেন। এই সাংসদরা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী, সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী আইনগুলিকে কোনও আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই নীরবে পাশ করিয়ে নিচ্ছেন।চক্ষুলজ্জার বালাই না রেখে তারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটেখাওয়া ৯৯ শতাংশ জনগণকে ভোটের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ১ শতাংশ মালিক শ্রেণির ‘জনপ্রতিনিধি’র ভূমিকা পালন করছেন।
সে কারণে একেকটা দলের অনেক সাংসদ, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্দশা বাড়তেই থাকে। আসলে কোনও দলের আদর্শ বলে যদি কিছু না থাকে, নীতি বলতে যদি বোঝায় পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখা, তা হলে বেশি সংখ্যক সাংসদ থাকলেও ওই দলগুলির ভূমিকা জনস্বার্থের নিরিখে শূন্য হতে বাধ্য। বাস্তবে তাই দেখা যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর ১৭ বার লোকসভা নির্বাচন হয়েছে, কোনও না কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে শাসকের আসনে বসেছে, বিরোধী দলের প্রতিনিধি হিসেবেও অনেকে জিতেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের খাদ্য-কাজ-শিক্ষা-স্বাস্থে্যর মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলি নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক করতে এই সাংসদদের দেখা যায়নি। এমনকি এই সমস্যাগুলি সমাধানের দাবিতে সরব হওয়ার চেষ্টাটুকুও করেনি ওই দলগুলির সাংসদরা।
এর ব্যতিক্রমও আছে। প্রকৃত সংগ্রামী দল যারা সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে সঠিক আদর্শের ভিত্তিতে পথ চলে তাদের যদি এক জন সাংসদও থাকেন, তা হলে তিনিই প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেন।২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়নগর কেন্দ্র থেকে জেতা এস ইউ সি আই (সি)-র সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডল এমনই প্রকৃত জনপ্রতিনিধির ভূমিকা পালন করেছেন। এস ইউ সি আই (সি) শ্রমিক শ্রেণির দল।মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের আদর্শের ভিত্তিতে ডাঃ মণ্ডল দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কী ভাবে এই বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থাতেও জনস্বার্থে বিপ্লবী দলের সাংসদদের ভূমিকা পালন করতে হয়।তিনি সংসদে প্রতিটি জনবিরোধী নীতির বিরোধিতা করেছেন। জনস্বার্থে কী কী কাজ করা দরকার তার প্রস্তাব দিয়েছেন।সাংসদদের বেতনবৃদ্ধির তীব্র বিরোধীতা করেছেন। সাংসদ কোটার টাকা, সাংসদদের বর্ধিত বেতনের টাকা এলাকার সামাজিক কাজে খরচ করে নজির সৃষ্টি করেছেন।
ফলে ধনী সাংসদরা যে পুঁজিপতিদেরই প্রতিনিধিত্ব করবে, সাধারণ মানুষের করবে না, তা বুঝতে হবে প্রতিটি সাধারণ মানুষকে। নির্বাচিত করতে হবে গরিব, মেহনতি মানুষের স্বার্থে সংগ্রাম করা প্রতিনিধিদের। সংসদীয় গণতন্ত্র আসলে বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কতন্ত্র। গণতন্ত্রের খোলসটা দিয়ে পুঁজিপতিদের একনায়কতন্তে্রর কঙ্কালটা ঢাকা থাকে। এখন সেই খোলসটা এতই জীর্ণ হয়ে পড়েছে যে, সংসদীয় গণতন্তে্রর আসল চেহারাটাকে বুর্জোয়ারা চেষ্টা করেও ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে এই শোষণমূলক বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে যারা বদলানোর ডাক দিচ্ছে, তাদের শক্তিশালী করাই আজ সময়ের আহ্বান।