স্বৈরাচারের আর এক নাম যে বর্তমান বিজেপি শাসন তার সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ হল সরকারি অফিসে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত নতুন আইন। এ বছর ৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত নয়া ‘মিডিয়া অ্যাক্রেডিটেশন গাইডলাইন’ এর মাধ্যমে কার্যত সরকারের পেটোয়া সাংবাদিক ছাড়া আর কোনও সাংবাদিক যাতে সরকারি অফিসে ঢুকতেই না পারেন সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
সরকারি বেসরকারি সমস্ত অফিস সহ আদালতে খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্য সাংবাদিকদের অবাধ যাতায়াতের অধিকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাংবাদিকরা সরকারের বিভিন্ন নতুন আইন কানুন, সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ভাবনাচিন্তা, পরিকল্পনা প্রভৃতি সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করে, তার ব্যাখ্যা এবং জনজীবনে প্রত্যাশিত প্রভাব এসব সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা করে জনসাধারণকে সচেতন করবেন এটাই প্রত্যাশিত। বুর্জোয়া ব্যবস্থা বিকাশের যুগে যখন গণতন্ত্র কিছুটা হলেও ফর দি পিপল, অফ দি পিপল, বাই দি পিপল ছিল–সে সময় সংবাদমাধ্যমকে বর্জোয়া গণতন্ত্রই আখ্যা দিয়েছিল রাষ্টে্রর চতুর্থ স্তম্ভ। যাদের কাজ সরকার এবং রাষ্টে্রর কর্ণধারদের অন্যায়কে জনসমক্ষে তুলে ধরা। কিন্তু বর্তমান বুর্জোয়া শাসকরা এ পরিসর দিতে নারাজ। বুর্জোয়া শাসকরা পুঁজিপতিদের শোষণ, লুঠ এবং নিজেদের শাসন ও আরাম আয়েসের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার যেসব গোপন ফন্দিফিকির ঠাণ্ডা ঘরে বসে আঁটে। সাংবাদিকরা বিভিন্ন আধিকারিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তার আঁচ পেয়ে বহুক্ষেত্রেই তা সংবাদমাধ্যমে আগাম ফাঁস করে দেন এবং গণপ্রতিবাদের চাপে সে সব পরিকল্পনা অনেক সময় ভেস্তে যায়। এর চমৎকার উদাহরণ হল, একদম হালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্কুল বেসরকারিকরণ করে আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার গোপন পরিকল্পনা সংবাদপত্রে ফাঁস হওয়া এবং এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর আন্দোলনের ফলে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে সরকারের ঢোক গেলা।
কিন্তু বিজেপি সরকার আরও বেপরোয়া। তারা এটুকুও বরদাস্ত করতে নারাজ। সরকারি নীতির সমালোচনা করতে পারেন বা সরকারের গোপন জনবিরোধী পরিকল্পনা ফাঁস করে দিতে পারেন এরকম সাংবাদিকরা যাতে সরকারি অফিসে ঢুকতেই না পারেন তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেস ইনফরমেশন বুরো সাংবাদিকদের ‘অ্যাক্রেডিটেশন’ বা ‘অনুমোদিত সাংবাদিক’ ছাপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। অনুমোদন দেওয়ার ভার থাকবে একটি কমিটির ওপর যা শুধুমাত্র সরকারি আমলাদের নিয়ে গঠিত হবে। তারা যদি মনে করেন যে, কোনও সাংবাদিক এমন সংবাদ পরিবেশন করছেন যা ‘ভারতের ঐক্য, সার্বভৌমত্ব, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনজীবনের শৃঙ্খলার পক্ষে হানিকর, সৌজন্য ও নৈতিকতার পরিপন্থী, আদালতের অবমাননা বা অপরাধে উস্কানি দেওয়ার সমতুল্য’ তা হলে সেই সাংবাদিকের অনুমোদন বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ তিনি আর সরকারি মহল থেকে কোনও খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারবেন না। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই মোদি সরকার ‘ভুয়ো খবর’ বা ফেক নিউজ নিয়ন্ত্রণ করার নামে অনলাইন মিডিয়াকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছিল। এর জন্য তারা একটা কমিটি গঠনও করেছিল। মন্ত্রকের সচিবদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কোনও প্রতিনিধিকে তাতে রাখা হয়নি। সাংবাদিক মহলের সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে পড়ে সরকার তখনকার মতো এই আইন প্রণয়ন স্থগিত রাখে, কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা যে তথ্যপ্রযুক্তি (অন্তর্বতী গাইডলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়া নৈতিকতা) বিধি, ২০২১ তৈরি করেছে তারও মূল উদ্দেশ্য কিন্তু সেই একই, অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ। ইতিমধ্যেই অনেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রক এবং মন্ত্রকের অধীন অফিসে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কোভিড প্রোটোকলের অজুহাতে সংসদ ভবনেও সাংবাদিকদের প্রবেশ প্রায় বন্ধ । কোভিড নিয়ন্ত্রণ বিধি শিথিল হওয়ার পরেও সাংবাদিকমহলের বারংবার আবেদন সত্তে্বও সংসদে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়নি। মোদি সরকারের এই গণতন্ত্র হত্যাকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা সোচ্চার হলেও মিডিয়া মালিকরা কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে রাজি নন, কেন না বর্তমানে নামীদামী মিডিয়া হাউস সবই একচেটিয়া পুঁজিপতিদের টাকায় তাদের তত্ত্বাবধানেই চলে। সরকারটাও চালায় তারাই। দেশি বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির লুঠের রাজত্ব অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠকে মোদি সরকার গলা টিপে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট নাৎসি শাসন প্রতিষ্ঠার সময় হিটলারও প্রথমেই স্বাধীনচেতা সংবাদমাধ্যমকে বন্ধ করে দিয়েছিল এবং অসংখ্য সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি অথবা দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। মোদি সরকার আজকের ভারতে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করতে চলেছে। সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সম্মিলিত সক্রিয় প্রতিবাদই একমাত্র এই ফ্যাসিবাদি আক্রমণকে রুখে দিতে পারে।