‘বেলা বয়ে যায়, খায়নি কো বাছা কচি পেটে তার জ্বলে আগুন’– ‘স্বাধীন’ ভারতের যে চিত্র অনুমান করে শিউরে উঠেছিলেন নজরুল, আজও তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য৷ আর ক’বছর বাদে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির উৎসবের রোশনাইয়ে দেশ ভেসে উঠবে৷ নানা পরিকল্পনা চলছে৷ চলছে এই ভারতে গণতন্ত্রের পীঠস্থান সংসদে মন্ত্রী–সাংসদদের নামমাত্র দামে চেটেপুটে চর্ব্যচোষ্য খাওয়া৷ তার থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে খোদ রাজধানী দিল্লির বুকে তিন শিশু খিদের জ্বালা নিয়েই ঢলে পড়ল জীবনের শেষ ঘুমে খিদে পেটে নিয়েই তারা সাত দিন ঘুমোতে গিয়েছিল৷ আট দিনের দিন আর ঘুম ভাঙল না৷ দিল্লিতে একই পরিবারের তিন শিশুর এই মর্মান্তিক মৃত্যু দেশের মানুষকে শিহরিত করেছে৷
ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের পর দিল্লির শিশুদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু দেশে বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্রকে সামনে নিয়ে এল৷ ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে, আট দিন ধরে তিন শিশুর পেটে খাদ্যের একটা কণাও ছিল না৷ শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মানসীর বয়স আট, সবচেয়ে ছোটর বয়স দুই, মাঝেরটি চার বছরের৷ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছে৷ ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না দেশের ‘চৌকিদার’ প্রধানমন্ত্রী থেকে দিল্লি সরকারের বড় বড় কর্তাদের সুখনিদ্রায় এতটুকু ব্যাঘাত ঘটায়নি৷
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই মানসীদের বস্তিবাড়ি৷ ঝাঁ চকচকে রাস্তা পেরিয়ে সংকীর্ণ গলি রাস্তা ধরেই পূর্ব দিল্লির মান্ডোয়ালি এলাকায় পণ্ডিত চকের বস্তি হতভাগ্য এই শিশুদের ঠিকানা৷ বাবা পেশায় রিক্সাচালক, নেশায় বেহুঁশ হয়ে বাড়ি ফিরত না প্রায়ই৷ মা মানসিক ভারসাম্যহীন৷ স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা স্কুল গেল কি না, খেল কি না দেখার কেউ ছিল না৷ প্রতিবেশীরা দয়াপরবশ হয়ে কখনও কিছু খেতে দিলে কিংবা বড় মেয়েটি স্কুলে গেলে মিড–ডে মিলের খাওয়া জুটত মাঝে মাঝে৷ হতদরিদ্র এই পরিবারটি বাড়ির ভাড়া মেটাতে পারেনি বলে বাড়িওয়ালা তাড়িয়ে দিয়েছিল৷ রেশন কার্ড, আধার কার্ড কিছুই ছিল না এদের৷ ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র কর্তাদের এই সব শিশুদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
কেন এভাবে মরতে হল তাদের? কোনও ভাবে কি এই শিশুগুলির মুখে খাবার পৌঁছনো যেত না? কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল ফুড সিকিওরিটি অ্যাক্ট, আইসিডিএস কিংবা তাদের ‘দয়ার দান’ ৪ টাকা ১৩ পয়সার মিড ডে মিল যে প্রকৃত ক্ষুধার্তের কাছে পৌঁছায় না, এই শিশুরা প্রাণ দিয়ে তা দেখিয়ে গেল৷ ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্যই যদি এগুলির প্রয়োগ না হয়, তাহলে এ সমস্ত থাকার দরকার কি? পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেন পাওয়া গেল না ক্ষমতাসীন কোনও দলের ‘সহৃদয়’ নেতাদের? মারা যাওয়ার পর অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত শিশুগুলির মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের কাছে ক্ষতিপূরণ নিয়ে ছুটছেন৷ হতভাগ্য শিশুগুলি বেঁচে থাকতে তাদের খিদে মেটাতে এরা কেউ ফিরেও তাকায়নি৷ এখন মিডিয়ার সামনে নিজেদের ‘দরদি’ প্রমাণ করতে এ বেলা–ওবেলা বিজেপি, কংগ্রেস, আপ নেতারা ছুটে যাচ্ছেন৷ শুধু এই শিশুগুলিই নয়, নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত, স্যাঁতসেতে, অন্ধকার বস্তিতে থাকা আরও অসংখ্য পরিবারের রেশন কার্ড নেই৷ তাদের খাদ্য জোগানোর কোনও সরকারি ব্যবস্থাই নেই৷ এই পরিবারগুলিতেও যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে মানসীদের মতো অসহায় মৃত্যুর ঘটনা৷
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান আফ্রিকার বৎসোয়ানা, বুরকিনা ফাসো, ইরাকেরও পিছনে৷ খাদ্যের অভাবে, অপুষ্টিতে ভুগে, অনাহারে কত শত মানসীর মৃত্যু ঘটে চলেছে বছর বছর– তার প্রকৃত পরিসংখ্যান কখনওই দেয় না সরকার৷ মৃত্যুর পর কিছুটা হইচইও হয়৷ কিন্তু এদের মৃত্যুর কারণ দূর করার চেষ্টা করে না কেউ৷ সমাজের আত্মসর্বস্বতা তো রয়েছেই, কিন্তু শুধু তাকেই দোষারোপ করে আমরা দায় সারতে পারি কি? রাষ্ট্রের কর্ণধাররা কিছু প্রকল্প ঘোষণা করেই এই ধরনের হতদরিদ্র পরিবারগুলির প্রতি দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারেন কি? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭০ বছর অতিক্রান্ত৷ দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, বর্তমানে বিজেপি৷ গরিব মানুষের খাদ্যের অধিকার নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুটেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী ‘আচ্ছে দিনে’র জয়গান গাইছেন৷ স্লোগান তুলছেন ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও৷’ কোন আচ্ছে দিন দেখছে ভুখা শিশুরা? কোন বেটিদের পড়ানোর কথা নেতারা বলছেন, যারা দু’বেলা দু’মুঠো খাবার না পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরে, তাদের?
একদিকে ৯৯ শতাংশ হতদরিদ্র মানুষ রুটি–রুজি হারিয়ে মনুষ্যেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, তিল তিল করে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে, অন্যদিকে এক শতাংশ ধনকুবেরের সম্পদ ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে, তাদের বিশাল আয়তনের পুঁজি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের ব্যাঙ্কে খাটছে৷ বিশ্বে সম্পদের নিরিখে দেশীয় পুঁজিপতিরা তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন৷ দেশের পুঁজিপতি তোষণকারী সরকারগুলির ‘দয়ায়’ টন টন খাদ্যশস্য সমুদ্রে ফেলে দেওয়া চলছে, সরকারি গুদামে মজুত খাদ্য পচে নষ্ট হচ্ছে, ইদুঁরে খেয়ে ফেলছে, তবুও এই ক্ষুধার্ত মানুষকে দেওয়া হচ্ছে না৷ এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দস্তুর৷
তিন শিশুর অসহায় মৃত্যু কি এই অন্যায় ব্যবস্থার সর্বনাশ লিখতে বিবেকের কাছে ডাক দিয়ে যায় না?
(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)