স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উৎসবের সরকারি নাম ‘অমৃত মহোৎসব’, আর এখন থেকে স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তির সময় পর্যন্ত আগামী ২৫ বছর হল ‘অমৃত-কাল’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই অমৃতকাল-এর প্রথম বাজেটে তাঁর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ চাষিদের উদ্দেশ্যে শুধু অমৃতবাণীই বিতরণ করলেন। গোল গোল শব্দের ফাঁকা আওয়াজের আড়ালে তিনি শিল্পপতি ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের জন্য চাষিকে লুট করার রাস্তা আরও প্রশস্ত করে দিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকদের উন্নতি ও গ্রামের উন্নয়নের জন্যই নাকি এই বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বাজেটে তিনি রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হলেও কী ভাবে সেই উৎপাদন বাড়বে তার হদিস বাজেটের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যখন চাষি ফসল বিক্রি করে দেবে, তারপর থেকে সেই ফসল উপভোক্তার কাছে পৌঁছানোর নানা স্তর পর্যন্ত যাতে ব্যবসায়ী পুঁজিপতিরা লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থা রয়েছে এই বাজেটের ছত্রে ছত্রে। বাজেট বত্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবছরটি ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলেটস ইয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। মিলেট এর অর্থ হল ক্ষুদ্র দানার খাদ্যশস্য–জোয়ার, বাজরা, রাগি প্রভৃতি। এগুলি এত দিন সাধারণত গরিবের খাদ্য হিসাবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এইসব ক্ষুদ্র দানাশস্যের পুষ্টিগুণ চাল ও গমের চাইতে বেশি হওয়ায় বর্তমানে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এই সমস্ত ফসল প্রসেসিং করে, বাহারি লেবেল সেঁটে, নানা ব্র্যান্ড নাম দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করছে। প্যাকেটে আকর্ষণীয় খাদ্যগুণ উল্লেখ করে দামটাও তেমন আদায় করছে। এই কর্পোরেট কোম্পানিদের আকাঙক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ফসল কাটার পর মিলেটের মূল্যমান বাড়ানো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার বৃদ্ধি ও ব্র্যান্ডিংয়ে সাহায্য করা হবে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, কৃষক নয়, প্রসেসিং ও ব্র্যান্ডিং কোম্পানিগুলিকে সাহায্য করাই অর্থমন্ত্রীর আসল উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অপর ঘোষণাটি হল, কৃষি ও গ্রামীণ শিল্প উদ্যোগের ব্যবসায় স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলিকে সরকার সাহায্য করবে। এই কর্মসূচিতে অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য ‘ব্লেন্ডেড ক্যাপিটাল’-এর কথা উল্লেখ করে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পুঁজিকেও বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। এখানেও চাষিকে সাহায্য নয়, কৃষিপণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের জন্যই যত সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতার আয়োজন।
এরই সাথে এমএসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সরকারের অংশীদার করে কৃষকদের প্রাকৃতিক চাষে সাহায্য করা হবে। এটা ঠিকই যে, বর্তমানে অত্যধিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে খাদ্য দূষণ ঘটছে এবং ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রিক আলসার সহ নানা রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার কি তার থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে তৎপর? আদৌ তা নয়। ইদানিং একদল ধনী অর্গানিক (রাসায়নিক মুক্ত) ফসলের ক্রেতা হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রীর হেঁশেলে যে মহার্ঘ (৩০ হাজার টাকা কিলো) হিমালয়ান মাশরুম রান্না হয় বলে শোনা যায়, তাও এর একটা উদাহরণ। প্রাকৃতিক চাষের নামে এই বাজারটি ধরার জন্য বৃহৎপুঁজির মালিকদের সুবিধা করে দিতে চাইছে সরকার। উত্তরপ্রদেশের ভোটের দিকে তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাজেট পরবর্তী বত্তৃতায় এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন গঙ্গা নদীর নামকেও। ‘পবিত্র গঙ্গা’কে নিয়ে হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। তিনি বলেছেন, গঙ্গার পার্শ্ববর্তী পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় প্রাকৃতিক চাষে জোর দেওয়া হবে। তাতেই নাকি ‘মা গঙ্গার সাফাই হবে’। অথচ গঙ্গার দু’পারে গড়ে ওঠা শহরগুলি দূষিত জল শোধন না করে গঙ্গায় ফেলা এবং শিল্প-কারখানাগুলি পরিবেশ আইনকে বুড়ো-আঙুল দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে গঙ্গার। তার উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের জমিতে রাসায়নিক ব্যবহারকেই দায়ী করলেন গঙ্গার দূষণের জন্য!
যদিও কৃষকদের জন্য আরেকটি ‘সুখবর’ দিয়ে অর্থমন্ত্রী হাই-টেক সার্ভিস ও ডিজিটাল পরিষেবা দেওয়ার কথা বলেছেন। এখানেও সরকার একা বা শুধু কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সরকারি ব্যাঙ্ক ‘নাবার্ড’ সাহায্য করবে না। এই ডিজিটাল পরিষেবা দেওয়া হবে পিপিপি মডেলে অর্থাৎ এখানেও প্রাইভেট কোম্পানিকে টেনে আনা হচ্ছে। সরকারি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ শাখার সাথে এই সব প্রাইভেট কোম্পানি যুক্ত হওয়ায় সরকারের গবেষণা উক্ত সম্প্রসারণ বিভাগের ফলটুকু আত্মসাৎ করবে কোম্পানিগুলি। বাজেটে বলা হয়েছে, চাষের কাজে ব্যবহার করা হবে ড্রোন। পরিষেবামূল্য দিয়ে ফসলে কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও উদ্ভিদের বৃদ্ধিকারক সার ও অন্যান্য রাসায়নিক স্প্রে করার কাজে ব্যবহার করা যাবে এই ড্রোন। যেখানে এই বাজেটেই সরকার বলছে প্রাকৃতিক চাষে জোর দেওয়া হবে, সেখানে ঠিক উল্টো কথা– ড্রোন ব্যবহার করে কীটনাশক, ছত্রাকনাশক স্প্রে করার কথাও বলা হচ্ছে। এছাড়াও ড্রোন ব্যবহার করা হবে জমির রেকর্ড ডিজিটাইজেশনের জন্য এবং ফসলের এলাকার মূল্যায়ন করার জন্য। এ দেশের কতজন কৃষকের পকেটে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো পয়সা আছে? বৃহৎ কোম্পানিগুলিকে কৃষিতে ঢোকানো বন্দোবস্তই এটা নয় কি?
এরই পাশাপাশি এই বাজেটে চাষের কাজে সেচের জল ব্যবহার করার জন্য পাঁচটি নদী সংযোগ করার কথা বলা হয়েছে, যেখানে আগামী আট বছরে ৪৪ হাজার ৬০০কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এই প্রকল্প যে ক্ষয়প্রাপ্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকে আরও বিপর্যস্ত করতে পারে তা বলাই বাহুল্য। উপরে উল্লেখিত ঘোষণাগুলিতে যেসব বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে তাতে চাষিরা যে কিছুই পাবে না, তা অত্যন্ত স্পষ্ট।
এবার চালু প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দের দিকে নজর দেওয়া যাক। সেচ এলাকা বৃদ্ধির জন্য পাঁচটি নদী সংযোগের কথা বললেও ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই (সেচ) যোজনা’র জন্য গত বছর যেখানে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, এ বছর তা কমিয়ে অর্ধেক অর্থাৎ দু’হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’র জন্য আগেরবার বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা, এবারের বাজেটে তার থেকে ৫০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষি সম্মান নিধি’-তে গত বছর ছিল ৬৭,৫০৯ কোটি টাকা, তখন সামান্য বাড়িয়ে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬৮ হাজার কোটি টাকা। মূল্যবৃদ্ধিকে হিসাবে ধরলে আসলে তা কমানেই হয়েছে। করোনা-কালে যখন কর্মসংস্থানের সুযোগ চূড়ান্তভাবে হ্রাস পেয়েছে, তখন প্রয়োজন ছিল গ্রামীণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য গত বছরের চাইতেও বেশি বরাদ্দ করা। অথচ গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ১০০ দিনের কাজে গত বছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯৭,০৩৪ কোটি টাকা, সেখানে এবারের বরাদ্দ ২৫ হাজার কোটি টাকা কমে হয়েছে ৭২,০৩৫ কোটি টাকা। ফলে, গ্রামের মানুষ নিজেদের গ্রামে কাজ না পাওয়ায় অন্যত্র কাজের খোঁজে ছুটে বেড়াতে বাধ্য হবে এবং বাড়বে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। কৃষিক্ষেত্র সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, এই বাজেট কৃষকদের নিঃস্ব করে পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের পকেট ভরানোর বাজেট।