দীর্ঘ দু-বছর বন্ধ থাকার পর রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সবে খুলে ছিল। ক্লাসরুম ভিত্তিক পঠন-পাঠন শুরু হয়েছিল। সাময়িক হলেও স্বস্তি ফিরেছিল ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় তাপপ্রবাহের কারণে রাজ্য জুড়ে ৪৫ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের হঠকারী, তুঘলকী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্য সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এতদিন ছুটি ঘোষণার আগে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, ছাত্র সংগঠন কিংবা চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়নি। শিক্ষক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী অথবা চিন্তাশীল মানুষদের কেউই কিন্তু দাবদাহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার দাবি তোলেননি।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকার যতই ছাত্রদের সুবিধার কথা বলুক, বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেবে। একদিন শিক্ষায় দেশের প্রথম সারিতে থাকা পশ্চিমবঙ্গ আজ শেষের সারিতে। এর দায় কি সরকার এড়াতে পারে?
এই প্রতিবেদন তৈরির সময় দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তাপপ্রবাহ নেই। বৃষ্টি যে শীঘ্রই হবে, আবহাওয়া দপ্তর তা ঘোষণাও করেছিল। তা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হল! বৃষ্টি যদি না-ও হত, তাহলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখার বিকল্প ভাবনা ভাবা যেত। রাজ্যে গরমের তীব্রতা সর্বত্র সমান নয়। উত্তরবঙ্গে তাপপ্রবাহ নেই। রাজ্য সরকার ওড়িশা সরকারের মতো সংক্ষিপ্ত ছুটি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে পারত। বিকল্প হিসেবে ভাবা যেত, যে জেলাগুলোতে তাপমাত্রার তীব্রতা রয়েছে সেখানে সকালে ক্লাস করার। পিরিয়ডের সংখ্যা কমিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখা যেত।
করোনা সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে ড্রপ আউট-এর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। পুনরায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বহু ছাত্র-ছাত্রীর সমস্যা হচ্ছে। দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্ররা রুজি-রোজগারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকের অথবা অন্য কোনও কাজ বেছে নিতে। তাদের স্কুলমুখী করা কঠিন হচ্ছে। আবার এতদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে ড্রপআউট আরও বাড়বে।
সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। এর আগেও রাজ্য সরকার পিপিপি মডেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা মৌখিক ঘোষণা করেছিল। আসলে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই শিক্ষাকে মুনাফা-যোগ্য পণ্য হিসেবে দেখছে, অধিকার হিসেবে নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো টানা বন্ধ রাখার অর্থ ছাত্র-ছাত্রীদের পুনরায় অনলাইন শিক্ষায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য করা। লকডাউন পর্বে বাইজুস, টিউটোপিয়ার মতো অনলাইন অ্যাপগুলো কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তাই স্কুলভিত্তিক পঠন পাঠন বন্ধ রেখে রাজ্য সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের পথ সুগম করছে এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে কোটি কোটি টাকা লাভের সুযোগ করে দিচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার সুযোগ মুষ্টিমেয় ধনী উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় দ্বারা শিক্ষায় সুস্পষ্ট দুটো শ্রেণি তৈরি করা হচ্ছে। যাদের অর্থ থাকবে তারাই অনলাইন পরিষেবা ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পড়াশোনা করতে পারবে। দেশের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, শ্রমিক-কৃষকের কাছে শিক্ষা হয়ে দাঁড়াবে বিলাসিতার নামান্তর। রাজ্য সরকার মুখে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করলেও বাস্তবে রাজ্যে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০’ কার্যকর করে চলেছে।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় যেমন ড্রপআউটের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনই দীর্ঘদিন ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। তার ফলে ছাত্র-শিক্ষকের অভাবে বহু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপমৃত্যু ঘটবে অচিরেই। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের শিক্ষাসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বহুকাল আগে বলে যাওয়া মনীষী টলস্টয়-এর উক্তি ‘জনগণের অজ্ঞতাই সরকারের শক্তির উৎস’, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও অমোঘ সত্য বলে মনে হয়। তাই রাজ্য সরকারের অবিলম্বে এই অবিমৃষ্যকারী, হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে শিক্ষার স্বার্থে স্কুল-কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়ন করা ও পাশাপাশি গরমের দীর্ঘ ছুটির যে নির্দেশিকা তা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।