শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের ২১তম সর্বভারতীয় সম্মেলন প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হল ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঝাড়খণ্ডের কয়লা শহর নামে খ্যাত ধানবাদে। প্রথম দিন নেহেরু ময়দান থেকে অগণিত লাল পতাকা ব্যানার ফেস্টুনে সুসজ্জিত ২২টি রাজ্য থেকে আসা প্রায় ১৫০০ প্রতিনিধি সহ পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারীর এক দৃপ্ত মিছিল সারা শহর পরিক্রমা করে কোহিনুর ময়দানে পৌঁছালে সম্মেলনের প্রকাশ্য সভার কাজ শুরু হয়। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ। শুরুতে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি আর তিওয়ারি আবেগমথিত কণ্ঠে বলেন, আমরা ধানবাদবাসী হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর এমন সুসজ্জিত সুশৃঙ্খল দৃপ্ত মিছিল দেখে অভিভূত।
প্রকাশ্য সভায় বাংলাদেশ থেকে আগত ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন’-এর নেতা কমরেড জহিরুল ইসলাম এবং কমরেড মাসুদ রেজা বক্তব্য রাখেন। প্রধান বক্তা সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর সাহা শুরুতে সম্মেলনে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য ধানবাদবাসীকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, একদিকে চলছে ব্যাপক ছাঁটাই, লে-অফ, লক-আউট, অন্য দিকে দেশে কোটি কোটি বেকার। তিনি কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষের কাজের দাবিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনাদের উপর শাসক শ্রেণি যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে আপনারা যাতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে না পারেন তার জন্য এনআরসি-সিএএ-এনপিআরের নামে আপনাদের বিভক্ত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এই আক্রমণ। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড সত্যবান ও কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত এবং এস ইউ সি আই (সি)-র ঝাড়খণ্ড রাজ্য সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড রবীন সমাজপতি।
ওই দিন সন্ধ্যায় শুরু হয় প্রতিনিধি সম্মেলন। সভা পরিচালনার জন্য কমরেডস সত্যবান, অচিন্ত্য সিনহা, দিলীপ ভট্টাচার্য ও রমেশ পরাশরকে নিয়ে সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয়। কিউবা, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান ও নেপালের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলির পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করে শোনানো হয়। খসড়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্টের উপর প্রতিনিধিরা বিস্তৃত আলোচনা করেন। দ্বিতীয় দিনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ডব্লুএফটিইউ-র ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি এবং এআইটিইউসি, সিটু, এআইসিসিটিইউ ও ইউটিইউসি-র নেতৃবৃন্দ সংগঠনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলনে সাম্প্রদায়িকতা, এনআরসি-সিএএ-এনপিআর এবং মহিলাদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব সহ বিদ্যুৎ, ইস্পাত, ব্যাঙ্ক শিল্প এবং রেল কমর্চারীদের উপর সরকারি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল স্কিম ওয়ার্কারদের সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি, কাজের অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ ২০ দফা দাবি সনদ নিয়ে প্রস্তাবের উপর আলোচনার পর তা গৃহীত হয়। তৃতীয় দিনে সমাপ্তি অধিবেশনে সংগঠনের নতুন সর্বভারতীয় কমিটি ও জাতীয় কাউন্সিল গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যথাক্রমে কমরেড শঙ্কর সাহা ও শঙ্কর দাশগুপ্ত নির্বাচিত হন।
সমাপ্তি অধিবেশনে আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। তিনি উপস্থিত শ্রমিক-কর্মচারী প্রতিনিধিদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই মহান লেনিনের নেতৃত্বে বিশ্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে সোভিয়েত রাশিয়ার আবির্ভাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মহান নেতা স্ট্যালিন ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানের ফলে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তার ফলে দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলনেরও ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বহু অধিকার অর্জিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে রাশিয়ার পতনের পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অবর্তমানে সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি ও শোষিত জনগণের উপর মারাত্মক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। পুঁজিবাদ আজ ক্ষয়িষ্ণু। সংকট জর্জরিত। তীব্র বাজার সংকট। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিঃশেষিত। পুঁজিবাদ জানে, মানুষ এর বিরুদ্ধে যে কোনও সময় আন্দোলনে ফেটে পড়তে পারে। তাই ভারতের শাসক শ্রেণি পরিকল্পিত ভাবে মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন না করতে পারে তার জন্য মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা সবই শেষ করে দিচ্ছে। ধর্মের নামে, জাতপাত-আঞ্চলিকতা-সংকীর্ণতা দিয়ে, নাগরিকত্বের নামে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, এনআরসি-সিএএ-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা সিপিআই, সিপিএম প্রভৃতি দলগুলির কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম, আসুন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা কেউই এই আবেদনে সাড়া দেয়নি। এই দলগুলি সংসদীয় রাজনীতির চর্চা করতে করতে এই পরিস্থিতিতেও কিছু আসন পাওয়ার আকাঙক্ষায় কংগ্রেসের মতো বুর্জোয়া দলের সাথে হাত মেলাচ্ছে।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার সাথে সাথে চাই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ব্যাপক চর্চা। চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির ব্যাপক অংশগ্রহণ। আপনাদের মধ্য থেকে ব্যাপক সংখ্যায় কর্মী চাই, সংগঠক চাই, নেতা চাই। যাঁরা এগিয়ে আসছেন, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাড়ির লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা, তাঁদের মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সম্পত্তিবোধের মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। ডি-ক্লাসড হতে হবে। শ্রমিকদের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে হবে। নিজ নিজ ক্ষেত্রের বাইরে যেতে হবে। আমার ক্ষেত্র, আমার শিল্প, আমার ক্ষেত্রের ইউনিয়ন, কেবল এরকম ভাবলে চলবে না। অন্য ক্ষেত্রের, অন্য শিল্পের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হবে। শ্রমিক শ্রেণিকে জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-আঞ্চলিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। এ সবের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সমাজের অন্যান্য মানুষের, কৃষকদের, ছাত্রদের, মহিলাদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধুমাত্র আর্থিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন নয়, সামাজিক আন্দোলনেও এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকদের আর্থিক দাবিদাওয়া কিংবা ভোটের রাজনীতিতে ফাঁসিয়ে রাখতে চায়। এর হাত থেকে মুক্ত হয়ে এই শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনেও শ্রমিকশ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য চাই আদর্শগত চর্চা।
তিনি সংগঠনের কর্মী-সংগঠকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা স্বেচ্ছায় কোনও স্বার্থ ছাড়াই এই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। আপনাদের বস্তিতে বস্তিতে যেতে হবে, তাদের সুখ-দুঃখের শরিক হতে হবে। তাদের সংগঠিত করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে। এর জন্য নিজেদের উদ্যোগ বাড়ান, কমিটির কার্যক্রম শক্তিশালী করুন। আরাম-আয়েস ত্যাগ করুন। শরীরচর্চা করুন। আদর্শগত মান বাড়ান। পত্র-পত্রিকা, বইপত্র পড়ুন। ঘরে ঘরে যান, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানা কর্মসূচি নিন। সকলের কাছ থেকে শিখুন, তাদের সংগঠিত করুন। কমরেড মাও সে তুঙ বলেছেন, ভাল শিক্ষক হতে চাইলে ভাল ছাত্র হতে হবে। বিপ্লবী সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করুন– উন্নত চরিত্রের অধিকারী হোন। আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়।