শারদোৎসবের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যে প্রশ্নটাকে প্রায় কেউই এড়াতে পারছেন না, তা হল, এ বারও উৎসব কি একই রকম ভাবে পালিত হবে? উত্তরটা আসলে এই প্রশ্নটার মধ্যেই মিশে রয়েছে। যদি একই রকম ভাবে তা আমরা পালন করতে পারতাম তবে এই প্রশ্নটা মনের মধ্যে এমন করে খচখচ করত না। জুনিয়র ডাক্তারদের অদম্য মনোবলে আন্দোলন প্রায় দু-মাস ধরে চলছে। সাধারণ মানুষ বহু অসুবিধা মেনে নিয়েও আন্দোলনে রয়েছেন। আপাত অনমনীয় রাজ্য সরকার বাধ্য হয়েছে কিছুটা নমনীয় হতে। আন্দোলনের অনেকগুলি দাবিই মেনে নিয়েছে। সেগুলি যাতে ঠিক মতো কার্যকর হয়, সে জন্য ডাক্তাররা হাসপাতালের কাজে যোগ দিয়েও আন্দোলন জারি রেখেছেন। কিন্তু এখনও মূল দাবি পূরণ হয়নি। নিহত ছাত্রীর খুনিরা সবাই ধরা পড়েনি– তাদের গ্রেফতার ও শাস্তি এখনও বাকি। সবারই প্রতীক্ষা– কত দ্রুত দোষীরা ধরা পড়বে, কবে তাদের শাস্তি হবে। জুনিয়র ডাক্তাররা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আন্দোলনের চাপ বজায় না রাখলে অন্যায়ের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ব্যবস্থায় ন্যায়ের দাবি আদায় হবে না। সাগর দত্ত হাসপাতালে ডাক্তারদের উপর সাম্প্রতিক হামলায় স্পষ্ট– নিরাপত্তা ও চিকিৎসা পরিকাঠামোর বিষয়ে অনেক দাবি আদায় বাকি। মানুষ তাই উৎসবের আবহাওয়াতেও ডাক্তারদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন।
এই যে সমাজের নানা স্তরের মানুষ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার রাস্তায় নামছেন, তা কি শুধুই আর জি করের নিহত চিকিৎসকের বিচার পাওয়ার দাবিতে? অবশ্যই এটাই প্রধান। কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও মিশে রয়েছে তার নিজের প্রতি ঘটে যাওয়া অসংখ্য অন্যায়ের বিচার চাওয়াও– সে অন্যায় ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, পেশাগত বা সামাজিক– যেমনই হোক। তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই অন্যায়ের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালের পরতে পরতে দুর্নীতির বাসা। তা যেমন জাল ওষুধ সরবরাহে, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনায়, মৃতদেহ এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারে, তেমনই টাকার বিনিময়ে ডাক্তারি শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেওয়া, নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, আবার অধ্যাপকদের বদলির ক্ষেত্রেও। তাই এমনকি জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিতে যাঁদের উপর চাপ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি সেই সিনিয়র ডাক্তার, অধ্যাপকরা– তাঁরাও আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, পা মিলিয়ে দিয়েছেন ছাত্রদের সঙ্গে একসাথে।
আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় যোগ দিয়েছেন যাঁরা, সেই মহিলারা মৃতার প্রতি আত্মীয়তা অনুভব করেছেন সবচেয়ে বেশি। তা এই কারণেও যে তাঁদের একটি বড় অংশ হয় ব্যক্তিগত ভাবে, না হয় তাঁদের কোনও না কোনও আত্মীয়, পরিচিত– রাস্তায়, বাসে-ট্রেনে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি বাড়িতেও অমর্যাদার, যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে চলেছেন। অবস্থা আজ এমনই যে, মনে হয় সমাজ বোধহয় নারীর এই অমর্যাদাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাতে তো অমর্যাদার শিকার নারীটির অন্তরে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা অসম্মানের জ্বালা জুড়োয় না! তাই আজ যখন বৃহত্তর সমাজ থেকে এক নারীর চরম অমর্যাদার বিচার চেয়ে ডাক এসেছে, তখন নারী হিসাবে সবার আগে সাড়া দিয়েছেন তাঁরাই।
যে শিক্ষক বিচার চেয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তাঁরও যেমন কিছু পেশাগত অসন্তোষ আছে, তেমনই আছে আরও বৃহত্তর যোগ। চোখের সামনে নিরুপায় ভাবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটির ভেঙে পড়া দেখতে দেখতে কখন যেন তাঁর মধ্যেও জমে উঠেছে ক্ষোভের বারুদ, জন্ম দিয়েছে দ্রোহের। এর প্রতিকারের দাবিই তাঁকে ঠেলে এনে যুক্ত করে দিয়েছে এই আন্দোলনে। এক নির্যাতিতার মৃত্যুর বিচারের দাবি তাই পরিণত হয়েছে এক বৃহত্তর লড়াইয়ে।
যে শিক্ষিত যুবকটি পিঠে খাবার কিংবা পণ্য সরবরাহের বিশালাকায় ব্যাগটি পিঠ থেকে নামিয়ে রেখে হাঁটছেন মিছিলে, তাঁর বুকের মধ্যে ইতিমধ্যেই জমে উঠেছে বঞ্চনার আরও অনেক ভারি বোঝা। সে বোঝা নামানোর কোনও জায়গা তিনি খুঁজে পাননি এই বিরাট সমাজের কোথাও। এই আন্দোলনের মধ্যেই সে যুবক খোঁজ পেয়েছেন তাঁরই মতো আরও এমন অনেক বঞ্চিতের। বঞ্চনাই মিলিয়ে দিয়েছে তাঁকে এক বৃহৎ সংগ্রামে।
সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা বিজ্ঞানী, আইনজীবী সহ নানা পেশাজীবী থেকে সমাজের নিচু তলার অসংখ্য শোষিত, নিপীড়িত মানুষ এই আন্দোলনে এসেছেন তাঁদের উপর প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা অন্যায়ের প্রতিকার খুঁজতে।
মুখ্যমন্ত্রী যতই আন্দোলন ভুলে উৎসবে যোগ দিতে বলুন, বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা এই অতৃপ্তি যেমন সমাজের সব স্তরের মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তেমনই তাঁরা ভুলতে পারছেন না নির্যাতিতার মুখ, সন্তানহারা বাবা-মায়ের বুকের ভিতরে অবিরল রক্তক্ষরণের কথা। সবার উপর ঘটা সব অন্যায়ের প্রতিকারের দাবি আজ এসে মিলেছে এক জায়গায়। তাই তাঁরা আজ ‘অভয়া’র আত্মীয়ে পরিণত হয়েছেন। আর আত্মীয়ের মৃত্যুতে কি উৎসব পালন করা যায়! উৎসব হয়তো হবে। কিন্তু তাতে বিচার চাওয়া এত মানুষের প্রাণের ছোঁয়া থাকবে না। একই সাথে মানুষের মনে ভেসে উঠছে রাজ্যের লাখ লাখ বন্যাকবলিত মানুষের মুখ, ত্রাণের জন্য হাহাকার যাঁদের চোখ থেকে শরতের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। উৎসবের রোশনাই আনন্দের বদলে যন্ত্রণাই দেবে এই মানুষগুলিকে। তাঁদের সহনাগরিক হিসাবে অন্যদেরও কি তা-ই দেবে না?