Breaking News

উলট পুরাণ — বিজেপির মুখে হঠাৎ বহুজাতিক বিরোধিতা

‘বানরে সঙ্গীত গায়, শিলা জলে ভেসে যায়/দেখিলেও না হয় প্রত্যয়…’

অনলাইন কেনাকাটার জগতের দৈত্যাকার বহুজাতিক সংস্থা অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট প্রভৃতিদের দেওয়া বিপুল ছাড়ের প্রতিশ্রুতি, এমনকী দ্রুত ডেলিভারির প্রতিশ্রুতির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আনতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ এমন কথা শুনলে আশ্চর্য না হয়ে উপায় আছে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির রামনাম করেই উত্থান এবং ভোটের সাধনায় সিদ্ধিলাভ, তা না হলে একে ভুতের মুখে রাম নামও বলা চলত৷ মাত্র কিছুদিন আগেই খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে কেন্দ্রীয় সরকারের উৎসাহদানের নীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে উত্তাল প্রতিবাদ উঠেছিল৷ ছোট ব্যবসায়ী সহ জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত ছিল যে, এর ফলে দেশের ছোট ব্যবসায়ীকুল প্রবল অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে নিশ্চিহ্ণ হওয়ার উপক্রম হবে৷ কিন্তু সরকার এবং কর্পোরেট পুঁজিমালিকদের বক্তব্য ছিল, এর ফলে এ দেশের ব্যবসায়িক পরিষেবা আরও উন্নত হবে৷ ক্রেতা সাধারণও আন্তর্জাতিক মানের পণ্যদ্রব্য ঘরে বসে কেনাকাটার  সুযোগ পাবেন৷ কয়েক বছর যেতে না যেতেই এখন তাঁরা এই বলে উল্টো গাইছেন যে, অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতায় পড়ে এ দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ স্বাভাবিকভাবেই সরকারের নতুন নীতিতে খুশি দেশের অনলাইন সংস্থা স্ন্যাপডিল প্রভৃতি৷ তাদের মতে প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই নাকি ‘বড় খেলোয়াড়রা নিয়ম ভাঙছে’৷ স্ন্যাপডিলের সিইও কুণাল বহেল বলেছেন, ‘প্রত্যেক বিক্রেতাকে এক পর্যায়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে নয়া নীতি’৷ বাণিজ্য প্রতিযোগিতাকে বিধিনিষেধের বাঁধনে বাঁধতে হবে? অবাধ বাণিজ্যের উপাসকদের মুখে এ কী কথা!

স্পষ্টতই অন্য সমস্ত সরকারি নীতির মতোই দেশীয় পুঁজিপতিদের অঙ্গুলিহেলনেই এই নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছে সরকার৷ মনে পড়ে, বর্তমানে যাঁরা বিজেপির প্রবল বিরোধিতা করে, আত্মহত্যাকারী কৃষকদের দুঃখে চোখের জলের গঙ্গা–যমুনা বইয়ে দিয়ে সেই নদীতে ২০১৯–এর ভোটের তরী পাড়ি দিয়ে আবার দিল্লির সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখছেন, নব্বই–এর দশকে সেই কংগ্রেস সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং–এর আমলেই নয়া শিল্প ও আর্থিক নীতিতে অবাধ প্রতিযোগিতা, খোলাবাজার, মুক্তবাজার প্রভৃতি নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল৷ তখন অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ক্রেতাসমাজকে এই বলে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল যে, এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের উন্নত মানের রকমারি পণ্য ভারতবাসী কিনতে পারবে৷ উন্নত বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়ে ভারতীয় সংস্থাগুলি তাদের পণ্য ও পরিষেবার গুণগত মান উন্নত করতে বাধ্য হবে, ইত্যাদি৷ অর্থাৎ যেন জনসাধারণের সুবিধের কথা ভেবেই এই উদারিকরণ, বিশ্বায়ন প্রভৃতি চালু করা হয়েছিল৷ ব্যাঙ্ক, বিমা, টেলিকম প্রভৃতি একের পর এক ক্ষেত্র এই যুক্তিতে দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল৷ এরই পথ বেয়ে সরকারি বদান্যতায় নিয়ে আসা হল খুচরো ব্যবসায় অবাধ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন এবং বনেদি সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির দেশগুলোর অনুকরণে সারা দেশ জুড়ে গড়ে তোলা হল মল–এ কেনাকাটা করার কালচার৷ তখনও সারা দেশ জুড়ে সাবেক ছোট ছোট দোকানদার এবং বাজার কমিটিগুলোর আপত্তি কানে তোলা হয়নি৷ ক্রমে ইন্টারনেটের আগমন এবং অনলাইন কেনাকাটার বাজার তৈরি হল এবং উন্নত বিশ্বে ইতিমধ্যেই এই ব্যবসায় অভিজ্ঞ বিভিন্ন সংস্থার হাত ধরে ভারতীয় বহুজাতিক পুঁজিগুলোও সাড়ম্বরে এই ব্যবসায় নেমে পড়ল৷ মজার ব্যাপার হল, মল গড়ে তোলার সময় যে বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর স্বার্থে ছোট স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আপত্তি কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলো কানে তোলেনি, বরং এই বিশাল বিশাল মল–মাল্টিপ্লেক্স গড়ে তোলাকে ‘উন্নয়ন হচ্ছে’ বলে প্রচার করেছিল, তারাই সরকারের কাছে অভিযোগ আনতে শুরু করল যে, অনলাইন কেনাকাটার বাড়বাড়ন্তের ফলে তাদের বিক্রিবাটা নাকি বছরে ৪০ শতাংশ কমে গেছে৷ এখন আবার বহুজাতিক অনলাইন সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দেশীয় সংস্থাগুলো অভিযোগ করছে যে, বহুজাতিকরা বিপুল ছাড় দেওয়ার ফলে দেশীয় সংস্থাগুলো প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে এবং সেইজন্য তাদের খুশি করতে কেন্দ্রীয় সরকার বহুজাতিক অনলাইন সংস্থাগুলোকে এদেশে ছাড় দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে৷ এমনকী অতি দ্রুত ডেলিভারি দেওয়ার ওপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে৷ এখন আর দক্ষ এবং উন্নত পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পরিষেবার মান উন্নয়নের তত্ত্ব তাদের মনে থাকছে না৷

বিশিষ্ট মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন যে, চূড়ান্ত সংকটগ্রস্ত, মরণোন্মুখ বিশ্ব পুঁজিবাদ এবং তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভারতীয় পুঁজিবাদ নিজেদের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে যতই নিত্যনতুন টোটকার ব্যবস্থা করতে চাইছে ততই সেই নতুন নতুন ব্যবস্থাগুলোই অচিরে আবার নতুন নতুন গভীরতর সংকটের জন্ম দিচ্ছে৷ এই ঘটনা তারই একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ৷ শুধু এ দেশেই নয়, বিশ্বায়নের চ্যাম্পিয়ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিই এখন নবোদিত চীনা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দাপটে গোটা বিশ্বে এমনকী নিজের দেশেও প্রতিযোগিতায় হটে গিয়ে, নিজেদেরই অঙ্গুলিহেলনে চলা ডব্লিউটিও–র নীতির বিরোধিতা করে চীনা পণ্যের ওপর বিপুল শুল্ক চাপাচ্ছে৷ উদারিকরণের বদলে আবার ‘দেশীয়’, ‘জাতীয়’ প্রভৃতি গণ্ডিবদ্ধ অর্থনীতির স্লোগান তুলছে৷ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দুঃখজনক পতনের পর গড়ে ওঠা একমেরু বিশ্বের অধীশ্বর সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিকুল নিজেরাই এখন বিশ্ব জুড়ে একাধিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পারস্পরিক বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ছে৷ প্রত্যেকেই অন্য দেশে অবাধ বাণিজ্য করতে চাইছে কিন্তু নিজের দেশে বিদেশি পুঁজি ঢুকতে দিতে নারাজ৷ এই বিষয়ে স্বদেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য জনসাধারণের দেশপ্রেমের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জাতীয়তাবাদী জিগিরও তোলা হচ্ছে৷ এসবেরই একমাত্র লক্ষ্য একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থ সংরক্ষণ৷ সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকার স্বার্থের সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্কও নেই৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৪ সংখ্যা)