উপেন্দ্র ভক্ত’র জীবনাবসান

কলকাতায় দলের তারাতলা লোকাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক কমরেড উপেন্দ্র ভক্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১১ মে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

তারাতলা সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় শিক্ষা আন্দোলন, গরিব মানুষের নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি বহুজনের প্রিয় মাস্টারজি হিসাবে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। ১৯৮০ সালে দলের তৎকালীন জেলা সম্পাদক ও পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জীর নির্দেশে বর্তমানে দলের রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড শিলাজিৎ সান্যাল পোর্ট ও তারাতলা এলাকায় সংগঠনের কাজ শুরু করেন। সেই সময় প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ও পাশ-ফেল প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে সারা রাজ্য জুড়ে আন্দোলন গড়ে উঠছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই কমরেড উপেন্দ্র ভক্তের সাথে দলের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনের প্রয়োজনেই দলের নির্দেশে তিনি তাঁর পুরনো স্কুল খিদিরপুরের হরিজন জ্ঞানপ্রকাশ বিদ্যালয় থেকে তারাতলায় হরিজন জ্ঞানমন্দিরে বদলি হয়ে আসেন। এই সময়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠন বিপিটিএ-র সাথে যুক্ত হন এবং সংগঠনের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

শুরু থেকেই কমরেড ভক্ত দলের বিস্তারের কাজে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। পোর্ট এলাকায় একেবারে গরিব মজুর, ঝুপড়িবাসী, নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করে নারীনিগ্রহ ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। পোর্ট অথরিটি যখন ঝুপড়ি উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়, তার বিরুদ্ধে গরিব মানুষকে সংগঠিত করে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে তিনি একদিকে যেমন গরিব মানুষের আপনজন হয়ে ওঠেন, অন্য দিকে কায়েমি স্বার্থের শত্রু হয়ে পড়েন। ভীতি প্রদর্শন, এমনকি জীবননাশের হুমকিও আসে। কিন্তু কোনও কিছুই তাঁকে আন্দোলন থেকে নিরস্ত করতে পারেনি। তাঁর এই সাহসী ও নেতৃত্বকারী ভূমিকার জন্য বাস্তবে তিনি পোর্ট এলাকায় জননেতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। শুধু বাইরের মানুষকে যুক্ত করেছেন তাই নয়, তিনি তাঁর স্ত্রী, কন্যা এবং পুত্রদের দলের সাথে যুক্ত করেন। আজ তাঁরা প্রত্যেকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী ও সংগঠক। তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজনদের মধ্য থেকেও অনেককে দলের সাথে যুক্ত করতে সক্ষম হন। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট, আয়ের উৎস সীমিত, সাংসারিক অভাব-অনটন রয়েছে, তখনও সবসময়ই তিনি পার্টির দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। পরবর্তীকালে পার্টি নেতৃত্ব যখন তাঁকে মহেশতলায় পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার নির্দেশ দেন, তখন অকেজো শরীর নিয়েও সেখানে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দলের চিন্তা ও কাজের মধ্যেই নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।

তাঁর চরিত্রের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল প্রকৃত উদার মন। সমস্ত জুনিয়র কমরেডদের সন্তানস্নেহে দেখতেন। তাঁর বাড়িতে সকলেরই ছিল অবাধ যাতায়াত। যারাই তাঁর কাছে আসত, তাদের সবসময় পার্টির প্রয়োজন ও তাৎপর্যের কথা বলতেন। দীর্ঘ পার্টি জীবনে আমৃত্যু পার্টির প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শন করে গেছেন। নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনাকেও তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করতে পারতেন। পরিবারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলের নেতৃত্বের কথাই ছিল শেষ কথা। তিনি তাঁর বাড়িকে পার্টি সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে পার্টি হিন্দিভাষী অঞ্চলের একজন যথার্থ জননেতা এবং পরীক্ষিত সৈনিককে হারাল। পোর্ট এলাকা ও মহেশতলায় যে শূন্যতা তৈরি হল তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

কমরেড উপেন্দ্র ভক্ত লাল সেলাম

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা