অঙ্কে শূন্য, ইংরেজিতে ১৷ সেই ছাত্র অঙ্কের চেয়ে ইংরেজিতে ভাল বলে বড়াই করলে কেমন হয়? ঠিক সেই অবস্থা এখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী–র্থম৷
বাজারে গেলে মানুষ দেখছে খাদ্যশস্য থেকে শাকসব্জি–মাছ কিছুতে হাত দেওয়ার উপায় নেই, সব একেবারে অগ্নিমূল্য৷ ওষুধ থেকে অতি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য জিএসটির কারণে মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে৷ রান্নার গ্যাস ওভেন বা বাড়ির অতিপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সারানো থেকে যে কোনও পরিষেবা নিতে গেলেই পকেট কাটছে জিএসটি–র চড়া হার৷ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে পেট্রল–ডিজেলের দাম৷ রান্নার গ্যাসের দাম প্রতি মাসেই বাড়ছে৷ কখনও কখনও তা একলাফে ৮০ টাকার বেশি বাড়ানো হচ্ছে৷ গরিবের সংসারের কেরোসিনেও ছাড় নেই, প্রতিমাসে বাড়ছে তার দাম৷ অন্যদিকে নোট বাতিলের ধাক্কায় কাজ হারানো অসংগঠিত ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজের আশায় হন্যে হয়ে ঘুরছেন৷ দেশের অধিকাংশ মানুষের কেনার ক্ষমতা এত নিচে নেমেছে যে অতি সাধারণ জিনিসেরও ক্রেতা নেই বাজারে৷ মুদির দোকান থেকে শুরু করে যে কোনও ক্ষেত্রের ছোট ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ– বাজারের অবস্থা খুব খারাপ৷ চড়া দামে সার–বীজ–কীটনাশক কিনে চাষ করে বহুজাতিক কোম্পানি–ফড়ে–মহাজন-ফাটকাবাজদের কবলে পড়ে চাষি বাধ্য হচ্ছে ফসলের অভাবি বিক্রিতে৷ প্রতি তিরিশ মিনিটে একজন চাষির আত্মহত্যা যেন সাধারণ ঘটনা হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের কাছে৷
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, এমনকী অর্থমন্ত্রকের ছোটবড় কর্তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মুডিজ রেটিং সংস্থার মূল্যায়ন আর তথাকথিত আর্থিক বৃদ্ধির ‘ভাল ফলে’র রিপোর্ট হাতে৷ প্রধানমন্ত্রী কথিত ‘আচ্ছে দিন’–এর গাজরটা দেখিয়েই তাঁরা ছোটাতে চান দেশকে৷
কোন ভাল ফলে তাঁরা এত উৎসাহিত বোধ করছেন? মার্কিন ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ‘মুডিজ’ ১৬ নভেম্বর বলেছিল, ভারতে লগ্নির ঝুঁকি এবং ঋণ দিলে তা মার যাবার ঝুঁকি আগের থেকে কিছুটা কমেছে৷ তাদের বিচারে ভারতের অবস্থান যেখানে ছিল, সেই ‘বিএএ–৩’ থেকে ‘বিএএ–২’ স্তরে এসেছে৷ এছাড়া ডিসেম্বরের প্রথম দিনটিতে প্রকাশিত রিপোর্টে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক বলেছে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিনমাসে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬.৩ শতাংশ৷ যা আগের তিনমাসে ছিল ৫.৭ শতাংশ৷ যদিও তাঁরা বলছেন না মুডিজ–এর রিপোর্টের ঠিক পরেই আর এক আন্তর্জাতিক রেটিং কোম্পানি ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’ (এস অ্যান্ড পি) তাদের রিপোর্টে ভারতের আগের অবস্থান অর্থাৎ একেবারে খারাপের ঠিক একধাপ আগে ‘বিবিবি’ স্তরেই রেখে দিয়েছে৷
এই রেটিং ধুয়ে জল খেয়ে সাধারণ মানুষের পেট ভরবে কি না, সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে দেখা যাক বিষয়টা কী বিশ্ব জুড়ে নানা কোম্পানি বিভিন্ন দেশ ও বড় বড় বহুজাতিকগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে সমীক্ষা চালায়৷ সেগুলি তারা সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের কাছে চড়া দামে বেচে৷ এদের মধ্যে তিনটি কোম্পানি মুডিজ, এস–অ্যান্ড–পি, এবং ফিচ হল সবচেয়ে বড়৷ এই সমস্ত তথ্য থেকে লগ্নির পরিকল্পনা করতে পুঁজিমালিকদের সুবিধা হয়৷ যে দেশ বিশ্বায়নের নির্দেশ মেনে যত বেশি আর্থিক সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের লুঠের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে তাকে তত বেশি ‘বিনিয়োগ বান্ধব’ তকমা দেওয়া হয়৷ যে বাজারে লগ্নির ভরসা সবচেয়ে বেশি তার তকমা হল ‘এএএ’ (ট্রিপল এ), তারপর নানা স্তর পেরিয়ে শেষ ধাপ হল ‘সি’৷ অর্থাৎ সেই সব দেশে লগ্নি করা বা ধার দেওয়া খুবই ঝুঁকির৷ কোম্পানি বিশেষে ভারতের রেটিং বিবিবি বা বিএএ ইত্যাদির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে বহু বছর ধরে৷ কখনও তা একটু কমে কখনও একটু বাড়ে৷
যদিও গোটা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিটাই এত অনিশ্চিত অবস্থায় আছে যে, এই সব রেটিং বা বিশেষজ্ঞের মতামতেরও কোনও নিশ্চয়তা পাওয়া ভার৷ যেমন ২০০৭–০৮ সালে বেশিরভাগ ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মার্কিন অর্থনীতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে অতি ভাল বলে ফিট সার্টিফিকেট দেওয়ার এক মাসের মধ্যে মার্কিন ব্যাঙ্কগুলি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল প্রবল আর্থিক সংকটের কারণে, যাকে সাবপ্রাইম ঋণ সংকট নামে অভিহিত করা হয়৷ সেই অর্থনৈতিক ধসে বহু সাধারণ মার্কিন নাগরিকের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল৷ মার্কিন সাংবাদিক ম্যাট টেবাই–এর মতে আগে এই রেটিং ‘অর্জন’ করতে হত, এখন ডলার ঢেলে অতি সহজেই উন্নত রেটিং ‘কেনা’ যায়৷ যে কারণে একদিকে নানা দেশের সরকার এই কোম্পানিগুলিকে বিভিন্ন পথে ঘুষ দেয়৷ অন্যদিকে চাপ দেয় ভাল রেটিং দেওয়ার জন্য৷ কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমই বলেছে মুডিজের ‘একটু ভাল’ রেটিং–এর পিছনে আছে ভারত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন প্রশাসনকে দেওয়া লগ্নি সংক্রান্ত চাপ৷
এই রেটিং–এর হিসাব কষা হয় তথাকথিত আর্থিক সংস্কারের উপর ভিত্তি করে৷ তার মানে সরকার যত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির বিলগ্নিকরণ করে, শ্রম আইন সংস্কার করে মালিকদের হাতে অবাধ ছাঁটাইয়ের অধিকার দেয়, মজুরি হ্রাস করে, শিক্ষা–স্বাস্থ্য সহ সমস্ত সামাজিক কল্যাণমূলক ক্ষেত্রে বরাদ্দ হ্রাস করতে থাকে, শিল্প গড়ে তোলার অজুহাতে সরকারি কোষাগারের টাকামালিকদের পাইয়ে দেওয়ার কাজে দরাজহস্ত হয়– তত বাড়ে দেশের ‘উন্নত’ রেটিং৷ দেশের শিশুকল্যাণের বরাদ্দের টাকায় ক্ষেপণাস্ত্র–ট্যাঙ্ক– বিমান তৈরির আয়োজন হলে রেটিং বাড়ে৷ দেশের মানুষের গচ্ছিত টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজিপতিরা যখন আত্মসাৎ করে আর সরকার মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় গড়া কোষাগারের টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কের তহবিল আবার ভরে দেয় যাতে আবার পুঁজিপতিরা ঋণ নিতে পারে– মার্কিন রেটিং সংস্থা তাকে বাহবা দেয়৷ ভারতে ৮ লক্ষ কোটি টাকা পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে৷ তাদের শীর্ষে থাকা আম্বানি–আদানিদের আবার ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার৷ বিজেপির এমপি বিজয় মাল্য ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে পকেটে পুরে ব্রিটেনে বসে আছে৷ সরকার সেই টাকা আদায় করা দূরে থাক দেউলিয়া আইন পরিবর্তন করে ঋণ খেলাপি পুঁজিপতিদের সহজে দায় ঝেড়ে ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছে৷ ফলে পুঁজিপতিদের স্বর্গরাজ্য হতে চাওয়া বিজেপি শাসিত ভারত ক্রমাগত সাধারণ গরিব মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষের বধ্যভূমি হয়ে উঠছে৷ অবশ্য কংগ্রেস বা অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলিও এই একই নীতির অনুসারি৷ এটাই পুঁজিবাদের নিয়ম৷ পুঁজিপতিদের ভাল মানে সাধারণ মানুষের সর্বনাশ৷ ফলে যে সংকট থেকে বের হওয়ার কথা ভেবে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দেশে দেশে বাজারের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, বাজার তৈরির প্রয়োজনে যে সব দাওয়াই দিচ্ছে– তাতে আরও কমছে মানুষের কেনার ক্ষমতা৷ ফলে বাজার আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে৷ পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ মুনাফার লালসাতে নিজের সংকট নিজেই এভাবে ডেকে আনে৷
তাই যখন আর্থিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে বলে সরকার দাবি করে তাতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোনও লাভ হয় না৷ এমনিতেও তথাকথিত বৃদ্ধি ঘটেছেও খুবই নগন্য৷ এই বৃদ্ধি মাপার ক্ষেত্রেও কারসাজি আছে৷ অনেকটা সিনেমার সেই জমিদার তনয়ের মতো, যে তির ছুঁড়ত আর একজন চাকর গিয়ে তিরের চারপাশে চাঁদমারি এঁকে দিত বাবুর সাফল্য প্রমাণ করতে৷ নরেন্দ্র মোদি সরকার কংগ্রেসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আর্থিক বৃদ্ধি মাপার ভিত্তিবর্ষ ক্রমাগত পাল্টে চলেছে৷ এতদিন কমপক্ষে দশ বছর আগের বৃদ্ধির সাথে তুলনা করে আর্থিক বৃদ্ধি দেখা হত৷ এখন সেটা এক বছর এমনকী এবারে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তিনমাসের হিসাবে মাপা হচ্ছে৷ তাতেও দেখা যাচ্ছে পরিকাঠামো ক্ষেত্র, পরিষেবা এবং কৃষিতে আর্থিক বৃদ্ধি অতি সামান্য৷ বাস্তবে প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য এবং কোটি কোটি বেকারের সংখ্যা, লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান কমা, কৃষকের দুর্দশা দেখিয়ে দিচ্ছে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কোনও আয় বাড়েনি৷
পুঁজিবাদী বাজার বিশেষজ্ঞদের কাগুজে হিসাব, তাদের নানা টোটকা, কোনও কিছুই এই ব্যবস্থার মরণদশাকে কাটাতে পারছে না৷ পারার কথাও নয়৷