২ মে বহরমপুরের রাস্তায় কলেজছাত্রী সুতপা চৌধুরির পৈশাচিক খুন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার কার্যকারিতাকে আরও একবার বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করাল। ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’-এর ভারত হোক বা ‘কন্যাশ্রী’র পশ্চিমবঙ্গ, নারীরা এ দেশে কেমন আছেন কী ভাবে বাঁচছেন, রোজকার সংবাপত্রেই তার পরিচয় মেলে। দিন মাস বছর পেরোয়, একটি তথাকথিত সভ্য দেশে খুন-ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি-নারীপাচারের সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলে। ১৯৯০-এর বানতলা, ২০১২-র দিল্লি, ২০১৩-র কামদুনি। পার্কস্ট্রিট-গাইঘাটা-কড়েয়া-নাকতলা, কাঠুয়া-উন্নাও-হাথরস। সাম্প্রতিক অতীতে নদীয়ার হাঁসখালি, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর। শাসক পাল্টায়, তারিখ পাল্টায়। নারী নির্যাতনের বীভৎস ছবিটা পাল্টায় না। একদিকে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের পাতাজোড়া উন্নয়নের বিজ্ঞাপন, অন্য দিকে নির্যাতিত নারীর আর্তনাদ। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র গত এক বছরে ৩৬,৪৩৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বাংলায়। ২০১৯ এ প্রতি ১৬ মিনিটে একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য বলছে, ধর্ষণের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। বলা বাহুল্য, নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি, কারণ পারিবারিক চাপ, লোকলজ্জার ভয় এর মতো নানা কারণে একটা বড় সংখ্যক অপরাধ প্রকাশ্যে আসে না। সংবাদপত্র খুললে বুক কেঁপে ওঠে, কন্যাসন্তানের মা-বাবা শিউরে ওঠেন সন্তানের ভবিষ্যত ভেবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন লাগামছাড়া ভাবে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা? সরকার কি এই জঘন্য অপরাধ কমাতে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে? বাস্তব কিন্তু ঠিক উল্টো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকঢোল পিটিয়ে আনা হচ্ছে দুয়ারে মদ প্রকল্প, কিছু ওয়েবসাইটে চলছে ‘রেপ গেম’, সাইবার পর্নোগ্রাফি নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে প্রতিনিয়ত নারীদেহকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ যেসব জিনিস মানুষকে প্রবৃত্তির দাস বানায়, বিকৃত যৌনতা উসকে দেয়, দিনের পর দিন তার উদযাপন চলছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সরকারি মদত ছাড়া এ জিনিস যে ঘটতে পারে না , সেটা আরও বোঝা যায় এইসব প্রশ্নে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা নীরবতা দেখলে।
ধর্ষণের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারীপাচার। খাতায় কলমে নারীপাচারের বিরুদ্ধে আইন আছে, আইনরক্ষার জন্য রাজ্যে দেশে পুলিশ-প্রশাসন আছে। অথচ বাস্তবে তাদের ভূমিকা কী? তথ্য বলছে, প্রতি বছর দশ লক্ষেরও বেশি নারী পাচার হয় এ দেশে। এতেও শীর্ষে আছে পশ্চিমবঙ্গ। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ২০১২ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, ভারতের বুকে বছরে কুড়ি লক্ষ মহিলা হারিয়ে যায়। ২০১৬ সালে ৩৫৫৯ জন পাচার হয়েছে এই রাজ্যে। কাজ দেওয়ার নামে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কত শত মেয়েকে যুক্ত করা হচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে, ফুটে ওঠার আগেই ঝরে যাচ্ছে কত স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খার কুঁড়ি।
অস্ত্র এবং মাদক পাচারের পরেই বিশ্বের তৃতীয় লাভজনক ব্যবসা আজ নারীপাচার। মা-বোনেদের দেহ নিংড়ে মুনাফাখোর পুঁজিমালিকদের পকেট ভরানোর এই প্রথা কি মধ্যযুগীয় বর্বর ক্রীতদাসপ্রথার চেয়ে কোনও অংশে কম বীভৎস? অথচ একটি ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে সরকার প্রচারিত ‘উন্নয়ন’-এর চোখধাঁধানো আলোর পাশেই বইছে এই নিকষ অন্ধকারের চোরা স্রোত। যাবতীয় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারীপাচার শিশুপাচারের এই বাড়বাড়ন্ত ঘটছে কী করে? এর জন্য দায়ী প্রশাসনের অবহেলা, ঔদাসীন্য এবং পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা, বহু ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের সাথে পাচারকারীদের গোপন আঁতাত।
ধর্ষণ-নারীপাচারের বাইরেও তালাক, পণপ্রথা সহ অসংখ্য কুপ্রথা এবং পারিবারিক হিংসার বলি হয়ে অজস্র নারী সুস্থ জীবনের বৃত্ত থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, ১৮-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের ৩০ শতাংশই ১৫ বছরের পর থেকে শারীরিক হিংসার শিকার হন। এমন রিপোর্ট-তথ্য-পরিসংখ্যান প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরেও, নারী নির্যাতনের ভয়ানক ছবিটা চোখের সামনে বারবার উঠে আসা সত্তে্বও সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা এ বিষয়ে নীরব, বড়জোর কখনও ঘটনার অভিঘাত প্রবল গণবিক্ষোভ তৈরি করলে তারা দু-একটা দায়সারা বিবৃতি দিয়েই কাজ সারেন। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, বহু নারী নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধী ধরা পড়ে না, ধরা পড়লেও তার কঠোর শাস্তির জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হয় নির্যাতিতার পরিবারকে। অপরাধের প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, অপরাধী নেতা-মন্ত্রী-প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর নিকটজন হলে তার সাতখুন মাফ হয়ে যাওয়া, নির্যাতিতা এবং পরিবারকে অভিযোগ প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়া এসব তো আছেই। এমনকি ধর্ষকের সমর্থনে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা মিছিল করছেন বা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান খুনি ধর্ষককে আড়াল করার চেষ্টা করছেন– সাম্প্রতিত অতীতে এমন লজ্জাজনক নজিরও তৈরি হয়েছে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-নেতাজির দেশে। আসলে, দেশের মানুষের জীবনের আর পাঁচটা জ্বলন্ত সমস্যার মতোই নারী নির্যাতন নারী অবমাননার প্রশ্নটিও পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোর সাথে যুক্ত। গদিতে বসার জন্য মানুষের সেবা করার, উন্নয়ন করার, নারীকে সুরক্ষা মর্যাদা দেওয়ার যত প্রতিশ্রুতিই শাসক দলগুলো দিক না কেন, এরা প্রত্যেকেই ভোটসর্বস্ব নোংরা রাজনীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, মানুষের মূল্য এদের কাছে শুধুমাত্র ভোটের অঙ্কে। মানুষকে লুটে মুনাফার পাহাড় বানানো একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের পায়ে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েই এরা ক্ষমতায় আসে। এই ব্যবস্থার রক্ষক এই দলগুলো এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত সরকার কখনওই নারী নির্যাতন রুখতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে না। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের বেহাল দশা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নৈতিক শক্তি এবং মেরুদণ্ড নষ্ট করে দিতে যুবসমাজকে অমানুষ বানানো এই মুনাফাসর্বস্ব ব্যবস্থার প্রয়োজন। তাই ড্রাগ-মদ-জুয়ার ঢালাও আয়োজন, ব্লু ফিল্ম-পর্নোগ্রাফির রমরমা, নারীদেহ নিয়ে কোটি টাকার ব্যবসা। একে রুখতে হলে একদিকে যেমন জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলে অপরাধীদের শাস্তি দিতে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে, অন্যদিকে বুঝতে হবে, পুঁজিবাদের শোষণ লুণ্ঠন যত বাড়বে, এই পচাগলা সমাজ তত দীর্ঘমেয়াদি হবে, আরও বাড়বে মনুষ্যত্বের অবনমন এবং তার অনিবার্য পরিণতিতে বাড়তে থাকবে নারী নির্যাতন। যে সমাজ সমস্ত মানুষের বিকাশের অগ্রগতির যাবতীয় পথকে রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই সমাজ কখনও নারীকে যথার্থ মর্যাদা বা মুক্তি দিতে পারে না। দরকার মূল্যবৃদ্ধি-বেকারি-দারিদ্রে জর্জরিত সাধারণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বেগম রোকেয়া-সাবিত্রীবাই ফুলে-র দেখানো পথে নিজেদের শিক্ষা ও চেতনার মান বাড়ানো। মনে রাখতে হবে, এই পুঁজিবাদী সমাজ উচ্ছেদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েই গড়ে উঠবে আজকের দিনে একটি যথার্থ প্রগতিশীল নারীমুক্তি আন্দোলন।