দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসেই নরেন্দ্র মোদি সরকার লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির লাগামছাড়া বেসরকারিকরণে নেমে পড়েছে৷ ২০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দ্রুত বিলগ্ণিকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে৷ নীতি আয়োগ বিলগ্নিকরণের জন্য ২৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেছে দিয়েছে৷ সব মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বিলগ্ণিকরণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে৷ বর্তমান পাঁচটি সংস্থার মধ্যে রয়েছে ভারত পেট্রোলিয়াম (বিপিসিএল), কনটেনার কর্পোরেশন (কনকর), শিপিং কর্পোরেশন, নিপকো ও তেহরি জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (টিএইচডিসিএল)৷ ৭৫টি জাতীয় সড়ক প্রকল্পও বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা৷
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিতে বিজেপি মন্ত্রীরা এত তৎপর কেন? মোদি সরকারের মুখপাত্র হিসাবে তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বলেছেন, ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়৷ তাঁর বক্তব্য, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পেশাদারিত্ব বাড়াতেই সেগুলির শেয়ার বেচবে কেন্দ্র৷ সত্যিই কি তাই? ২২ নভেম্বর সংসদে দাঁড়িয়ে রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়াল কিন্তু ঠিক উল্টো কথা বলেছেন৷ গোটা রেলব্যবস্থার বেসরকারিকরণে প্রাথমিক পর্যায় হিসাবে শ’খানেক ট্রেন বিজেপি সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে৷ স্টেশন সংলগ্ন রেলের বিপুল পরিমাণ জমিও লিজের নামে বেসরকারি মালিকদের দিয়ে দিচ্ছে৷ সাফাই কাজ থেকে টিকিট বিক্রি– একের পর এক পরিষেবা চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাতে৷ এমনকি পুঁজিপতিদের দায়মুক্ত করতে এতদিন রেলের কাজে জমিহারাদের চাকরি দেওয়ার সংস্থানটিও প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার৷ এই অবস্থায় রেলকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চরম জনবিরোধী বলে সমালোচনায় মুখর হয়েছে৷ এই বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে রেলমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁরা আদৌ রেলে বেসরকারিকরণ করছেন না৷ যা হচ্ছে, তা হল বাণিজ্যকরণ৷ অর্থাৎ রেলমন্ত্রীর মতে রেল নিয়ে সরকার ব্যবসাই করতে চাইছে৷ তা হলে তেলমন্ত্রী না রেলমন্ত্রী– কার কথাটা সত্য? নাকি কেউই আসল সত্যটা বলছেন না?
তা ছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি ব্যবসা করার জন্য গড়ে উঠেছিল, বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা এমন তথ্য কোথায় পেলেন? স্বাধীনতার পর অর্থনীতির ভিত্তি হিসাবে মূল তথা ভারী শিল্পগুলিকে জনসাধারণের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প হিসাবে গড়ে তুলেছিল সরকার৷ শক্তি, রেল সহ সমস্ত পরিবহণ, সড়ক, বন্দর, তাপ ও জলবিদ্যুৎ, লোহা–ইস্পাত, পরমাণু শক্তি, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, জাহাজ নির্মাণ, তেল, কয়লা, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ভারী শিল্পগুলি ছিল এর অন্তর্গত৷ ঘোষণা করা হয়েছিল, জনগণের টাকায় নির্মিত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প জনগণকে পরিষেবা দেবে৷ এগুলি মুনাফা লোটার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়৷ সদ্য–স্বাধীন রাষ্ট্রের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলাই ছিল এগুলি স্থাপনের মূল লক্ষ্য৷ সেদিন প্রধানত পুঁজিপতিদের উৎপাদনের কাজে সুবিধা করে দিতেই সরকার পরিকাঠামো সহ ভারী শিল্পগুলি গড়ে দিলেও সেই সময় তা জনস্বার্থও অনেকখানি রক্ষা করেছিল৷ অথচ আজ জনস্বার্থের কোনও তোয়াক্কা না করে সেই সংস্থাগুলিকে বিজেপি নেতারা তাঁদের ঘনিষ্ট শিল্পপতি আম্বানি–আদানিদের কাছে জলের দামে বেচে দিচ্ছে৷
বিজেপি মন্ত্রীরা বলছেন, পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্যই নাকি তাঁরা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির শেয়ার বেচছেন৷ কিন্তু পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য শেয়ার বেচতে বা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিতে হবে কেন? সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত পেশাদার নিয়োগ এবং সরকারের সঠিক নজরদারিই তো ছিল তার যথার্থ উপায়৷ বিজেপি মন্ত্রীরা উল্টো পথে হাঁটছেন কেন? সচেতন মানুষ প্রশ্ণ তুলছেন, বিজেপি নেতারা লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির শেয়ার না বেচে বিপিসিএলের মতো বিপুল লাভ করা সংস্থাগুলিকে বেচে দিচ্ছেন কেন? বিপিসিএল ২০১৮–১৯ সালে লাভ করেছে ৭৮০০ কোটি টাকা৷ পেশাদারিত্ব না থাকলে, পরিচালনা দক্ষ না হলে এই বিপুল পরিমাণ লাভ করল কী করে? পেশাদারিত্বের কথাটা যে অজুহাত মাত্র তা আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় বিপিসিএলকে বেচে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকায়৷ বিপুল মুনাফা ছাড়াও সংস্থাটির মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা৷ তার মানে, সরকার জলের দামে বেচে দিচ্ছে সংস্থাটি৷ এর কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই বেরিয়ে আসবে সরকারের আসল উদ্দেশ্যটি৷ সরকার কাদের কাছে বেচছে এই সংস্থাগুলি?
বিপিসিএলের কথাই ধরা যাক৷অর্থমন্ত্রকের পক্ষ থেকে ক্রেতা হিসাবে বেশ কিছু বিদেশি সংস্থার নাম উচ্চারণ করা হলেও সেই তালিকার প্রথম নামটিই ইদানিং প্রধানমন্ত্রীর অতি–ভক্ত সাজা মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের৷ ঠিক একইরকম ভাবে শিপিং কর্পোরেশন এবং কনটেনার কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে প্রথম নাম হিসাবে উঠে আসছে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহদের কল্যাণে সম্পদ–বৃদ্ধিতে উল্কাগতিতে দু–নম্বরে উঠে আসা আদানি গোষ্ঠীই৷ ‘ব্যবসা করা সরকারের উদ্দেশ্য নয়’, ‘পেশাদারিত্ব বাড়াতেই বিলগ্ণিকরণ’ ইত্যাদি কথা বলে বিজেপি নেতারা কাদের স্বার্থকে জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে চাইছেন, তা বুঝতে এরপর আর কারও অসুবিধা হওয়ার কথা কি?
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের দক্ষতা বোঝাতে ঘোষণা করেছিলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে দেবেন৷ কিন্তু তাতে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কী যায়–আসে? এর ফলে কি তাদের জীবনে দ্বিগুণ সমৃদ্ধি আসবে? তার উত্তরে মানুষকে স্তোক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কেক বড় হলে সবার ভাগও বড় হবে৷ কিন্তু কথা তো ছিল তিনি অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে এ কাজ করবেন৷ অর্থাৎ দেশে প্রচুর পরিমাণে কলকারখানা খুলবেন৷ তাতে যেমন দেশে উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়বে, তেমনই বছরে দু’কোটি করে বেকার সেখানে কাজ পাবে৷ কথা ছিল, সবার জীবনে ‘আচ্ছে দিন’ নিয়ে আসবেন, প্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধ করবেন৷ বাস্তবটা কী দাঁড়িয়েছে? অর্থনীতি প্রবল মন্দায় হাবুডুবু খাচ্ছে৷ জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে৷ একের পর এক কারখানায় তালা ঝুলছে৷ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক–কর্মচারী ছাঁটাই হচ্ছে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত তলানিতে নেমে যাচ্ছে৷ বৃদ্ধির হার নামতে নামতে প্রথম ত্রৈমাসিকে ৫ শতাংশে এবং পরের ত্রৈমাসিকে ৪.৫ শতাংশে নেমে এসেছে৷ অর্থনীতি ধুঁকতে থাকায় আয়কর এবং জিএসটি আদায়ও কমে গেছে৷ ব্যাঙ্কগুলিতে পুঁজিপতিদের শোধ না করা ঋণের পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে৷ কর ফাঁকি মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে প্রতারণার অঙ্ক অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসেই দাঁড়িয়েছে ৯৫,৭০০ কোটি টাকা৷ দৈনিক ২২ হাজার কোটি টাকা করে কালো টাকা জমছে৷ মেক ইন ইন্ডিয়া আকাশকুসুমে পরিণত হয়েছে৷ বেকারত্ব বৃদ্ধির হার গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে৷
এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা সরকারের কাছে ‘ত্রাণ প্রকল্পে’র আবদার জানাতে থাকে৷ সরকারও সেই আবদার মেনে নিয়ে কর্পোরেট করে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড় ঘোষণা করেছে৷ আবাসন প্রকল্পগুলির আবদার মেনে ২৫ হাজার কোটি টাকার ফান্ড গড়ে দিয়েছে৷ টেলিশিল্পগুলির কাছে সরকারের ন্যায্য পাওনা ১.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা সুপ্রিম কোর্ট তিন মাসের মধ্যে মিটিয়ে দিতে বলেছিল, সরকার তা দু’বছরের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে৷ অথচ পুঁজিবাদী বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, মন্দার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল, সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতার অভাব৷ অর্থাৎ কলে–কারখানায় পণ্য উৎপাদিত হলেও তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে না৷ তা হলে উপায় কী? উপায় তো হল, যাতে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়ে, তার ব্যবস্থা করা৷ অর্থাৎ নানা উপায়ে সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়ানো৷ বাস্তবে তা না করে সরকার পুঁজিপতিদের থলিতেই আরও টাকা ঢেলে চলেছে৷ যেন পুঁজিপতিদের পকেটে টাকা ঢাললে সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়বে উল্টেরেল, মোটরগাড়ি, টেলিকম সহ প্রায় সমস্ত শিল্পে লাখে লাখে কর্মরত মানুষকে মালিকরা ছাঁটাই করে চলেছে৷ এর দ্বারা এই চরম মন্দার সময়ে, যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষের দুবেলা পেঠভরে খাবার জোগাড় করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, তখন পুঁজিপতিরা কিন্তু তাদের মুনাফা বাড়িয়েই চলেছে৷
এই ভাবে পুঁজিপতিদের ছাড় দিতে দিতে সরকারি কোষাগারের যখন হাঁড়ির হাল, তখন আবার সেই ঘাটতি মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে নির্বিচারে বেচে দিয়ে কোষাগার ভরাচ্ছে৷ এর দ্বারা একদিকে সরকার মন্দার সংকটে ভুগতে থাকা পুঁজিপতিদের জলের দামে লাভজনক সংস্থাগুলি দিয়ে তাদের সহজে মুনাফা বাড়ানোর রাস্তা করে দিচ্ছে, অন্য দিকে যতটুকু হোক সেই টাকায় কোষাগার ভরছে আবারও তাদেরই সেবা করার জন্য৷ কিন্তু জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা সরকারি সম্পত্তিগুলি এই ভাবে বেচে দেওয়ার অধিকার বিজেপি নেতারা পেলেন কোথায়? তাঁরা সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন মানে কি জনগণ তাঁদের যা খুশি করার অধিকার দিয়েছে? না দেয়নি৷ তাঁরা আসলে জনমতকে দু’পায়ে মাড়াচ্ছেন৷ কংগ্রেসের থেকেও আরও নিপুণ ভাবে বুর্জোয়া তথা পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করে চলেছে বিজেপি৷ তাই কর্পোরেট পুঁজিপতিরা বিজেপিকে জেতাতে এবারের লোকসভা নির্বাচনেও গত নির্বাচনের মতো হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলেছিল৷ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি ক্ষমতায় বসা মানে শিল্পপতিদের ‘আচ্ছে দিন’ আর সাধারণ মানুষের ঘোর দুর্দিন৷ তাই বিজেপি সরকার শিল্পপতি–পুঁজিপতিদ্ জন্য দেদার করছাড়, করফাঁকি, ব্যাঙ্কঋণ মকুব, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে জলের দামে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ করে চলেছে৷ বিপরীতে জনগণের জীবনে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার মতো মারাত্মক বোঝা চেপেই চলেছে৷ কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, মানুষের আচ্ছে দিনের মোহ দ্রুত কেটে যাচ্ছে৷ ‘সবার বিকাশে’র মুখোশের আড়ালে থাকা আসল মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ তারই প্রতিফলন ঘটছে দেশজুড়ে শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের ক্রমাগত বাড়তে থাকা বিক্ষোভগুলির মধ্যে৷