ঝুপড়িতে বসে ছোট একটি মেয়ে দেখছে কী সুন্দর দেওয়াল উঠছে। উৎসাহী মেয়ে মাকে বলছে– ‘দেখ মা, আমাদের নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে।’ সন্তানকে বুকে আঁকড়ে মা বলছেন, ‘ঘর নয়, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হচ্ছে আমাদের ঝুপড়ি’।
বাস্তবে গরিবির হাড়-পাঁজরা আড়াল করার চেষ্টা শাসক দলগুলি স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বারবার করেছে। এবারে দেখা গেল মোদির রাজ্য গুজরাটে। সারা দেশে উন্নয়নের ‘গুজরাট মডেল’ দেখিয়েছিল বিজেপি সরকার। সেখানে নাকি দারিদ্র নেই, বেকারি নেই, গৃহহীন মানুষ নেই, সেখানে নাকি শিল্পায়নের রথ এমন ছোটে যে, সব অভাব মুখ লুকোয়! সেই ‘গুজরাট মডেল’-এর স্বরূপ এমনই যে দারিদ্রের দগদগে ঘা ঢাকা দিতে আজ সেখানে পাঁচিল তুলতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে।
২৪ ফেব্রুয়ারি দু’দিনের ভারত সফরে আসছেন বিশ্বের স্বঘোষিত প্রভু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁকে খুশি করে আরও বেশি মারণাস্ত্র বানানোর অর্ডার জোগাড় করা দরকার। তাতে ভারতীয় ধনকুবেররা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠবেন। সেখানে বস্তির কদর্য চেহারা, পূতিগন্ধময় রাস্তা, হাড় জিরজিরে শিশুর দল নিতান্ত বেমানান। তাই আহমেদাবাদের ওই বস্তি ৪০০ মিটার লম্বা এবং সাত ফুট উঁচু পাঁচিলে ঘিরে দিচ্ছে প্রশাসন। যত দ্রুত সম্ভব এই কাজ শেষ করতে কমপক্ষে দেড়শো কর্মী দিনরাত কাজ করছেন। গুজরাটের বিজেপি সরকার এই বাবদ মোট ব্যয় করেছে ১২০ কোটি টাকারও বেশি। যে রাস্তা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের গাড়ি যাবে, সেই রাস্তাকে শুধু ঝাঁ চকচকে করতে ৮০ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই খরচ করে ফেলেছে সরকার। বিপুল ব্যয়ে চলছে রাস্তার দু’পাশ সৌন্দর্যায়নের কাজ। আগরা, মথুরা ও বৃন্দাবনের মোট তিন হাজার শিল্পী সৌন্দর্যায়নের কাজ করছেন (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা,২০ ফেব্রুয়ারি)।
আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে নামার পরে মোতেরা স্টেডিয়ামে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা মার্কিন প্রেসিডেন্টের। ট্রাম্পের কনভয় যে পথ দিয়ে যাবে সেখানে বস্তি ও ঝুপড়ির জন্য যাতে দৃশ্যদূষণ না ঘটে, সেজন্য পাঁচিল দিয়ে ঘিরেই প্রশাসন নিশ্চেষ্ট থাকেনি। এর মধ্যে ৪৫টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বস্তিতে প্রায় ২০০০ মানুষের বসবাস, যাদের অনেকেই তথাকথিত পুঁজিবাদী উন্নয়নে উচ্ছেদ হয়ে এখানে রয়েছেন। এঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ে, এঁদের অনেকে নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে শহরে কাজ করেন। এঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আবারও উচ্ছেদের মুখে। সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ। রোজগার হারিয়ে তারা এখন পথে বসেছেন।
স্টেডিয়াম উদ্বোধনের জন্য মাত্র তিন ঘণ্টা আহমেদাবাদে কাটাবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ওই সময়ে তাঁর নিরাপত্তার জন্য বিপুল ব্যয় করে ১২ হাজার পুলিশ কর্মী মোতায়েন রাখা হচ্ছে। এরপর তিনি যাবেন আগরায় তাজমহল পরিদর্শনে। সেজন্য দুর্গন্ধ চাপা দিতে যমুনা নদীর তিনটি লকগেট থেকে এক সপ্তাহে অতিরিক্ত ১৭০ লক্ষ লিটার জল (স্বাভাবিকের দ্বিগুণ) ছেড়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকার (দ্য টেলিগ্রাফ, ২১ ফেব্রুয়ারি)। আগরা এয়ারপোর্ট থেকে তাজমহল যাওয়ার রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। তাজমহলের আশপাশে থাকা দোকানগুলিকে ইতিমধ্যেই সরকার নির্ধারিত সাইনবোর্ড ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।
২০১৭ সালে ট্রাম্প-কন্যা ইভাঙ্কার সফরের আগে রাতারাতি হায়দরাবাদ শহরের রাস্তাঘাট থেকে সমস্ত ভিখারিদের উচ্ছেদ করেছিল তেলেঙ্গানার তৎকালীন কে চন্দ্রশেখর রাও সরকার। ২০১৪ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং এবং ২০১৭-এ জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যখন গুজরাত গিয়েছিলেন, তখনও একই কৌশলে দেশের গরিবি আড়ালের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বস্তি আড়ালের এত চেষ্টা সত্ত্বেও গরিবি কি আড়াল করা যাচ্ছে? সরকারি হিসাবেই ভারতের জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন।বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১০২। ৩৬ কোটিরও বেশি ভারতীয় এখনও পর্যন্ত দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে পারেন না (তথ্যসূত্র : দ্য অ’ফোর্ড প্রভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ)। যত দিন যাচ্ছে ধনী-দরিদ্রে আয়ের বৈষম্য ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে চলেছে। ট্রাম্প সাহেবকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে হয়ত নরেন্দ্র মোদিরা নতুন কোনও ‘স্বপ্ন দেখানো’র স্লোগান তৈরি করবেন। কিন্তু তাঁদের নীতি অর্থাৎ দেশি-বিদেশি ধনকুবেরদের স্বার্থে চলা নীতিই যে এই অতল দারিদ্রের কারণ, তাকে আড়াল করবেন কী দিয়ে?