Breaking News

উন্নয়নের গল্প ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী মগ্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোয়

আচ্ছা, দশটা বছর কোনও একটা সরকারের পক্ষে কি খুব কম সময়?এই সময়ে জনগণের জন্য কি এমন কিছু করা সম্ভব নয়, যা নির্বাচনের আগে তাঁদের সামনে তুলে ধরা যায়?বলা যায়, তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমার সরকার এই এই কাজ করেছে, আরও কাজ করার জন্য আমাদের ভোট দাও?

সকলেই বলবেন, অবশ্যই দশটা বছর মানুষের জন্য কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময়। তা হলে বিজেপি নেতাদের নির্বাচনী বক্তৃতাগুলি থেকে উন্নয়নের গল্প উধাও হয়ে গেল কেন?কেন এখন তাঁদের বক্তৃতায় শুধুই সাম্প্রদায়িকতার বিষ?

রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর মাত্র দশ বছরের মধ্যে লেনিন-স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার দেশের খোল-নলচে পুরো বদলে দিয়েছিল। একটা পিছিয়ে পড়া, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তুলেছিল। মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলি সব মিটিয়ে ফেলার মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল–যা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রাশিয়া না-হয় ছিল একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ। তার কথা বাদ দেওয়া যাক। নরেন্দ্র মোদির সরকার কি তার দশ বছরের শাসনে চাইলে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কিছুই করতে পারত না? সেগুলিই তো নির্বাচনের আগে দেশের মানুষের সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীরা ভোট চাইতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো কিছু দিন আগেও দু-বেলা দেশের মানুষকে পাঁচ ট্রিলিয়ন, সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির গল্প শোনাচ্ছিলেন, পঞ্চম শক্তিধর দেশ থেকে তৃতীয় শক্তিধর দেশে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্নের কথা বড় গলায় শোনাচ্ছিলেন। তা হলে সে সব ছেড়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর রাস্তা ধরছেন কেন?

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক নির্বাচনী বক্তৃতাগুলি থেকে হঠাৎই উন্নয়নের ফিরিস্তি উধাও।পরিবর্তে দেশের মানুষ দৈনন্দিন জীবন যে হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত সেগুলির সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়গুলিকেই সামনে নিয়ে আসছেন তিনি।সাম্প্রদায়িকতার বিষে ভরপুর তাঁর এখনকার বক্তৃতাগুলি। তীব্র মেরুকরণই যার একমাত্র লক্ষ্য। বিশেষ করে দ্বিতীয় দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে যেন অনেকটা মরিয়া দেখাচ্ছে। তার কারণ কি এই যে, তাঁরা বহু খুঁজেও তাঁদের ঝুলিতে মানুষের জন্য সত্যিকারের উন্নয়নের কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না? নির্বাচনের সময়ে ট্রিলিয়ন ডলারের গল্পে যে ভোটের চিঁড়ে ভিজবে না, সাধারণ মানুষ যে বুঝে নিতে চাইবে নিজেদের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া কতটুকু পৌঁছেছে, তা বিজেপি নেতারা ভালই বুঝতে পারছেন।

প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দিতে গিয়ে এখন জনতার উদ্দেশে বলছেন, মোদির ৪০০ আসন দরকার, না হলে কংগ্রেস বাবরি মসজিদের তালা রামমন্দিরে লাগিয়ে দিতে পারে। বলছেন, কংগ্রেস নাকি একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের উদ্দেশে বলছে, মোদির বিরুদ্ধে ভোট জিহাদ করো। কখনও তিনি হিন্দুদের উদ্দেশে বলছেন, বিরোধীরা জিতলে আপনাদের সম্পত্তি কেড়ে নেবে। বাড়ির মহিলাদের গহনা কেড়ে নেবে। এমনকি হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্রটিও কেড়ে নেবে। পরিষ্কার ধর্মীয় উস্কানি। মুসলিমদের সম্পর্কে বিদ্বেষের মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা। লক্ষ্য–হিন্দু ভোটকে একত্রিত করা।

চতুর্থ দফা ভোটের আগে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের তৈরি করা একটি মনগড়া রিপোর্ট তুলে ধরে বিজেপি প্রচার করতে নেমেছে, দেশে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে এবং হিন্দুদের সংখ্যা কমছে। কোথা থেকে পেলেন তাঁরা এমন রিপোর্ট? বাস্তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই জন্মের হার কমছে। মুসলিমদের মধ্যে জন্মের হার সব থেকে বেশি কমেছে।

২০১৯-২১ সালের পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা বলছে, জাতীয় গড় টিএফআর (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) নেমে গিয়েছে রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ২.১ এর নীচে। ১৯৯২ থেকে ২০১৯ এই তিন দশকের মধ্যে হিন্দুদের টিএফআর ৩.৩ থেকে কমে হয়েছে ১.৯। মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা ৪.৪ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২.৪-এ। অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্যে সন্তানের জন্মের হার কমেছে তুলনায় অনেক বেশি হারে। (আবাপ, ১৩ মে, ২০২৪)। বুঝতে অসুবিধা হয় না, মেরুকরণের উদ্দেশ্যেই মুসলিমদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মিথ্যা গল্প ছড়াচ্ছেন বিজেপি নেতারা, যাতে হিন্দুদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া যায় যে, তারা বিপন্ন এবং একদিন বাড়তে বাড়তে মুসলিমরা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে। অবশ্য এমন মিথ্যা ভাষণ প্রধানমন্ত্রীরা এ বারই প্রথম করছেন এমন নয়। হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধির আতঙ্ক ছড়ানোর এই অস্ত্রটি তাদের অনেক পুরনো এবং বহু ব্যবহৃত। স্বাধীনতার আগের থেকে তাঁরা এই অস্ত্র ব্যবহার করে আসছেন। বিজেপির পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভা পরাধীন দেশে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করত তারও হাতিয়ার ছিল এই একই মিথ্যাচার।

আবার দিশাহীন প্রধানমন্ত্রী তফসিলি জাতি উপজাতি এবং ওবিসিদের সভায় গিয়েও একই রকম মিথ্যাচার করছেন। বলছেন, বিরোধীরা জিতলে তোমাদের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিয়ে দেবে। তাই বিজেপিকে ভোট দাও।

আসলে রামমন্দির নিয়ে বিজেপি নেতারা যেমনটি ভেবেছিলেন, এই দিয়েই তাঁরা আসমুদ্রহিমাচল হিন্দুদের মন জয় করে নেবেন, যে জন্য প্রধানমন্ত্রী অসমাপ্ত মন্দিরই উদ্বোধন করে দিলেন, বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি।মন্দির উদ্বোধনের সময় মন্দির ঘিরে যে আবেগ লক্ষ করা গিয়েছিল, গত তিন-চার মাসে তার বেশির ভাগই উধাও।খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার ভয়াবহ ব্যয়বৃদ্ধি, বেকারত্ব নিয়ে মানুষের তীব্র ক্ষোভ বাকি সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ মানুষের সামনে বিজেপি নেতাদের দিশেহারা দশা।তাই মরিয়া হয়ে তাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির রাস্তাকেই বেছে নিয়েছেন।

এর আগে কোনও প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দখলে রাখতে এত নীচে নামতে দেখা যায়নি।এত মিথ্যাচার, জাত-ধর্ম-বর্ণে এমন নজিরবিহীন উস্কানি এর আগে কোনও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। দুটো বেশি ভোট পাওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে যতটুকু মূল্যবোধ টিকে ছিল, সম্প্রীতির মনোভাব অবশিষ্ট ছিল, সেই সবকিছুকে আজ তিনি টেনে নামাচ্ছেন।ধর্ম-বর্ণ-মতের বৈচিত্র্যে মধ্যেও ঐক্যের যে সুর ছিল ভারতের ঐতিহ্য, তাকে ধ্বংস করছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল।

আসলে গত দশ বছরের বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা জনমানসে আজ একেবারে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। যুব সমাজ তীব্র বেকারত্বে জর্জরিত।প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে মহিলারা নির্যাতিতা হচ্ছেন। দলিত-আদিবাসী-পিছিয়ে পড়া অংশ এবং সংখ্যালঘুরা প্রবল বৈষম্যের শিকার। দেশ জুড়ে একই ছবি। এই অবস্থায় সর্বত্র বিজেপি নেতারা মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়ছেন। উন্নয়নের গালগল্পে যে মানুষকে ভোলানো যাবে না তা বিজেপি নেতারা বুঝে গেছেন। তাই উন্নয়নের গল্প বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী নগ্ন মেরুকরণের রাস্তাকেই বেছে নিয়েছেন।

বাস্তবে অবক্ষয়িত পুঁজিবাদের সেবক দলগুলি এবং তার নেতারা নৈতিক ভাবে ক্রমাগত বেশি করে দেউলিয়া স্তরে নেমে যাচ্ছেন।পুঁজিবাদের সেবায় যে দল যত বেশি দক্ষতা দেখাচ্ছে সে দলের নেতারা তত বেশি হীন পথ নিচ্ছেন।এ শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত দেউলিয়াপনা, নীতিহীনতা নয়, ব্যবস্থা হিসাবে যে পুঁজিবাদের তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছেন,সেই পুঁজিবাদই আজ নৈতিক ভাবে দেউলিয়া, নিঃস্ব। মানুষকে, সভ্যতাকে তার আর উন্নত কিছু দেওয়ার নেই। ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদ পচে গিয়ে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। তারই প্রতিফলন ঘটছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়। পচে যাওয়া এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে ব্যক্তি, দল বা সরকারের বদল ঘটিয়ে এই সঙ্কটের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।

এই সঙ্কট থেকে সমাজকে, সভ্যতাকে, মানুষকে রক্ষা করতে হলে চাই পুঁজিবাদের চেয়ে উন্নত সমাজব্যবস্থা, উন্নত আদর্শ। তার জন্য চাই মার্ক্সবাদ–আদর্শ হিসাবে যা সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে মানবিক, সবচেয়ে আধুনিক। তাই একজন যথার্থ মার্ক্সবাদী নেতা যখন জনগণের সামনে বক্তব্য রাখেন তখন তা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, পথ দেখায়, তাদের নৈতিক মান উন্নত করে, তাঁদের বাঁচার জন্য লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগায়।

মার্ক্সবাদীদের কাছে নির্বাচনও তার বিপ্লবী সংগ্রামের অংশ।নির্বাচনের মধ্যেও সে মানুষকে সচেতন করে যে, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থাকে অটুট রেখে শুধু ভোট দিয়ে হাজার বার সরকার পাল্টেও মানুষের জীবনের দুরবস্থা বদলাবে না। কারণ তার জীবনের সমস্ত দুর্দশার জন্য দায়ী এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।এই ব্যবস্থার বদলের জন্য দরকার বিপ্লবী সংগ্রামকে তীব্র করা।সেই সংগ্রামের যাঁরা প্রতিনিধি, বিপ্লবী সংগ্রামের বার্তাকে পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্বাচনে বিপ্লবী প্রতিনিধিদের জয়ী করা আজ অত্যন্ত জরুরি, যাতে শোষিত মানুষের বাঁচার দাবিতে রাস্তার লড়াইকে পার্লামেন্টের ভেতরেও পৌঁছে দেওয়া যায়।