দিল্লিতে প্রতিদিন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। রচনা করছেন কৃষক সমাজ। জনগণ ইতিহাস রচনা করে– এই সত্য প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে দিল্লির রাজপথে। এই প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ কৃষক– বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী– সবাই অদম্য মনোবল, অসীম বীরত্ব নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখে তাদের একটাই কথা– দাবি না মানা পর্যন্ত, কৃষক বিরোধী তিনটি কালা আইন ও বিদ্যুৎ আইন-২০২০ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। দাবি আদায় না করে তাঁরা ঘরে ফিরবেন না। তার জন্য যত মূল্য দিতে হয় তাঁরা দেবেন। ইতিমধ্যেই মূল্য তাঁরা দিতে শুরু করেছেন, ৫৯ জন সংগ্রামী মানুষ আত্মবলিদান করেছেন, প্রয়োজনে আরও করবেন, কিন্তু সফল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না।
দিল্লি থেকে কৃষক আন্দোলনের এই উদ্দীপনাময় অবস্থার কথাই জানালেন এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ। তিনি শুধু দিল্লির অবস্থানেই নয়, পাঞ্জাবে, হরিয়ানায়, উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে যাচ্ছেন। তাঁদের সংগঠিত করার কাজে গোটা সংগঠনের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান ও রাজস্তরীয় কৃষক নেতৃবৃন্দ। দিল্লির সিংঘু বর্ডার থেকে তিনি লিখছেন,
কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ভেবেছিল কৃষক বিরোধী এই তিনটি কালা কানুন কৃষকেরা মেনে নেবে। এখানে ওখানে হয়ত একটু প্রতিবাদ হবে, কিন্তু তা ডান্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেওয়া যাবে– আইন চালু করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু সরকারের এই হিসাব কৃষকরা উল্টে দিয়েছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, সরকার কৃষকদের নির্বোধ অসহায় মনে করলেও, বাস্তবে তারা তা নয়। তারাও সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে।
সরকারকে পিছু হঠতে কৃষকরা ইতিমধ্যেই বাধ্য করেছে। ওরা ভেবেছিল, ব্যারিকেড তৈরি করে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, ভারি ভারি বোল্ডার ফেলে, জায়গায় জায়গায় রাস্তা কেটে দিয়ে, জলকামান, বন্দুক, টিয়ার গ্যাস দিয়ে তারা কৃষকদের আটকাবে। সব বাধা ব্যর্থ করে দিয়ে কৃষকরা দিল্লির উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়েছে। এবং মাসাধিক কাল ধরে সড়কের উপর বসে আছে। যতদিন প্রয়োজন ততদিন বসে থাকবে এই ঘোষণাও করেছে।
এই আন্দোলনে এআইকেকেএমএস সহ অসংখ্য কৃষক সংগঠন যুক্ত হয়েছে। তাদের চিন্তা আলাদা, দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, স্বার্থও ঠিক একরকম নয়। তাই সরকার ভেবেছিল, সহজেই এই আন্দোলনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে, আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যাবে। সেই উদ্দেশ্যে ওরা কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু সফল হয়নি। মতভেদ যাই থাক না কেন, কৃষকদের সংগ্রামী চেতনা কৃষক সংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বাধ্য করেছে। ফলে, বিভেদ সৃষ্টির কাজে সফল না হয়ে ওরা পেটোয়া কিছু মানুষকে কৃষকদের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছে, তারা আবার আইনের স্বপক্ষে বিবৃতি দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কাজে সরকারকে সাহায্য করেছে। কিন্তু কৃষক সমাজ এই সব দালাল নেতাদের ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আর একটা ঘৃণ্য পথ গ্রহণ করেছে বিজেপি সরকার। তা হল, আন্দোলনের গায়ে কালি ছেটাও, মিথ্যা বদনাম দাও। ওদের ধারণা ছিল, বশংবদ মিডিয়ার প্রচারের ঢক্কানিনাদে এই কাজে ওরা সহজেই সফল হবে। সেই কালি ছেটানোর কাজ ওরা শুরুও করেছিল জোরকদমে। আন্দোলনকারীরা খালিস্তানি, সন্ত্রাসবাদী– ইত্যাদি কত কথাই না বলেছে বিজেপি নেতারা। আর সেই সুরে সুর মিলিয়ে কর্পোরেট পুঁজির মালিকানাধীন ‘দালাল মিডিয়া’ তারস্বরে চিৎকার করে বলেছে আন্দোলনকারীরা দেশদ্রোহী, উন্নয়ন বিরোধী। মানুষ এই সব অপপ্রচারের স্বরূপ বুঝতে পেরেছে এবং তা প্রত্যাখান করে আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র, যুবক, মহিলা, বুদ্ধিজীবী সহ সমাজের সর্বস্তরের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনকে সক্রিয় সমর্থন করেছেন, তাকে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন। আন্দোলনকে আরও বেগবান ও গতিশীল হতে সাহায্য করেছেন।
হালে পানি না পেয়ে বিজেপি ও তার বশংবদ মিডিয়া আর একটা কথাও প্রচার করার চেষ্টা করছে। বলছে, এ তো শুধু পাঞ্জাবের আন্দোলন। ভাবখানা এমন, যেন নয়া কৃষি আইনে পাঞ্জাবের কৃষকেরাই অখুশি, অন্যেরা এর সমর্থক। যেন অন্য রাজ্যের কৃষকরা একে দু’হাত তুলে সমর্থন করছেন। কিন্তু বিষয়টা মোটেই যে তা নয়, তা দিল্লিতে উপস্থিত ক্রমবর্ধমান কৃষক জনতার দিকে তাকালেই যে কেউ টের পাচ্ছেন। সংগ্রামের এই মহামিলন ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতবর্ষ তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্নাটক, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরালা– কে নেই সেখানে? সবাই রণাঙ্গনে এক মন এক প্রাণ হয়ে লড়াই করছেন। আবার সব রাজ্যেই জ্বলছে এই সংগ্রামের মশাল। ধরনা, লাগাতার অবস্থান, বিক্ষোভ, আইন অমান্য, শপথ নেওয়া, আইনের প্রতিলিপি পোড়ানোর মধ্য দিয়ে সেখানে আরও বৃহত্তর সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজ চলছে। তাই এ লড়াই শুধু পাঞ্জাবের লড়াই নয়, এ সমগ্র ভারতের কৃষকদের লড়াই। সমগ্র দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যয়ী স্লোগান– ‘লড়েঙ্গে, জিতেঙ্গে’, লড়ব, জিতব এবং জিতবই।
বিজেপি নেতাদের আর একটা অঙ্ক ছিল। তা হল কৃষকদের সাথে আলোচনার নামে কালহরণ করা। তা হলে কৃষকরা এই প্রবল শীতে কাবু হয়ে হতাশাগ্রস্ত মন নিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাবে। তাই আলোচনার নামে ডেকে সরকার বার বার একই কথা বলেছে, কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার কোনও সদিচ্ছাই দেখায়নি। সরকারের এই চাল কৃষকরা ধরে ফেলেছে। যত দিন যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে কৃষকদের মনোবল তত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে হার-না-মানা মনোভাব।
কিন্তু কোথায় পেলেন কৃষকরা এই অদম্য তেজ, এই অফুরন্ত প্রাণশক্তি? কোথায় পেলেন তারা এই হার-না-মানা মনোবল? কোনও রাজনৈতিক দল তো এ অর্জনে তাদের সাহায্য করতে পারেনি, কোনও কৃষক সংগঠনও তো তাদের এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করেনি। এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত ইতিহাসের গতিধারায়। নিষ্পেষিত, নিপীড়িত মানুষের মানসলোকে লুক্কায়িত মুক্তি আকাঙক্ষার গর্ভ থেকে এভাবেই এই ধরনের সংগ্রামী তেজের জন্ম হয়, শাসকের বিরুদ্ধে তা শতধারায় ফেটে পড়ে এবং উপযুক্ত বিপ্লবী নেতৃত্ব যথাযোগ্য শক্তি নিয়ে উপস্থিত থাকলে তা কখনও কখনও সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটিয়ে দেয়। ইতিহাসে এই ভাবেই গণবীরত্বের জন্ম হয়। এই ভাবেই মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে।
কৃষকরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝেছেন, কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের মতোই একচেটিয়া বহুজাতিক পুঁজির সেবা করে চলেছে। যে আর্থিক নীতি, শিল্প নীতি, কৃষি নীতি কংগ্রেস সরকার চালু করেছিল, তাকেই বিজেপি সরকার আরও জোরকদমে কার্যকর করছে। ফলে জনগণের জীবনে দুঃখ, দারিদ্র্য, যন্ত্রণা আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কৃষকরা উপলব্ধি করেছেন, বেসরকারিকরণ মানেই জনগণের সর্বনাশ, কর্পোরেট পুঁজির পৌষমাস। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এই হল জনগণের অভিজ্ঞতা। কৃষকরা দেখেছেন সার, বীজ, তেল ইত্যাদি বেসরকারি হাতে চলে যাবার পর এই সবের দাম কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, কেমন ভাবে এক ধাক্কায় চাষের খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। আর এই বাড়তি খরচ মেটাতে তাদের কেমন ভাবে সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে অনেক বেশি সুদে টাকা ধার করতে হয়। এই দেনার দায় মেটাতে হয় কৃষককে জীবন দিয়ে। প্রতি ১২ মিনিটে ভারতে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেন। এই হল পুঁজির নিগড়ে বাঁধা কৃষি অর্থনীতির বাস্তব চিত্র। ফলে এই কৃষকরা যখন দেখলেন, বেসরকারিকরণের বাইরে থাকা যতটুকু সরকারি ব্যবস্থা এখনও এ দেশে বেঁচেবর্তে আছে, বিজেপি সরকারের এই নতুন কৃষি আইন তাকে সমূলে উৎখাত করবে, তখন তারা আর স্থির থাকতে পারলেন না, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
কৃষকেরা এ-ও বুঝেছেন, এই আইন প্রয়োগ হলে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য চলে যাবে বহুজাতিক পুঁজির হাতে। চাল, ডাল, গম, সব্জি, দুধ, মাছ– সবকিছুর মালিক হয়ে যাবে তারা। তারা সস্তা দরে কিনবে আর অগ্নিমূল্যে বিক্রি করবে। এতে কৃষক মরবে, মরবে সাধারণ গরিব মানুষ। আর করপোরেট পুঁজির লাভের পাহাড় বাড়তেই থাকবে। আর এই কাজ বাধাহীন ভাবে করার জন্য চাই এমন ব্যবস্থা যাতে মরতে মরতে এখনও যতটুকু কৃষিজপণ্যের সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা আছে তা ধবংস হয়ে যায়। এ জন্য মান্ডি ব্যবস্থা ধবংস কর, সরকারি মান্ডি ধীরে ধীরে তুলে দাও। না, আইন করে তুলে দেওয়ার দরকার নেই। এমন ব্যবস্থা কর যেন তা আপনা আপনি উঠে যায়। এই জন্য বেসরকারি মান্ডি চালু কর, আর বর্তমান মান্ডি ব্যবস্থার অধীন গ্রামগুলো তাদের হাতে তুলে দাও। এতে ধীরে ধীরে সরকারি মান্ডিগুলো কমজোর হয়ে যাবে, তারপর একদিন উঠে যাবে। এরপর আসবে কর্পোরেট কর্তাদের অবাধ রাজত্ব। বাজারে তখন তারা ছাড়া কৃষকের ফসল কেনার কেউ থাকবে না– একেবারে খোলা বাজার। যেমন খুশি কম দামে কেন, যেমন খুশি বেশি দামে বিক্রি কর। কৃষক নিধনের কী সুন্দর ব্যবস্থা! একেই মোদিজিরা কৃষক কল্যাণকামী আইন বলে চালাবার চেষ্টা করছেন।
এর পর আছে চুক্তি চাষ। মোদিজিরা এর প্রশংসায় মুখর। বলছেন, এই চুক্তি চাষে নাকি কৃষকের অনেক উপকার হবে। কিন্তু আইনের সমস্ত দিকগুলো খুঁটিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যায় চুক্তির সমস্ত শর্ত কর্পোরেটের পক্ষে। পণ্যের গুণাগুণ অনুযায়ী দাম, আর গুণাগুণ ঠিক করবে বহুজাতিক কোম্পানি, কৃষকের সেখানে কোনও হাত নেই। ফলে কোম্পানিগুলো কৃষককে ঠকাবে, ইচ্ছামতো কম দাম দেবে, বা চুক্তি করার পর কৃষকের ফসল কিনবে না– কোনও ক্ষেত্রেই তার কিছু করার থাকবে না। এটা ঘটবেই বুঝে সরকার কৃষকের আইনি সাহায্যের কথা বলেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির সাথে অসহায় কৃষক আইনি লড়াই করে পারবে? তাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে জলের দরে কৃষককে ফসল তুলে দিতে হবে বহুজাতিক কোম্পানির গুদামে। এই ভবিতব্য কৃষক মেনে নিতে পারে না। তাই পথের লড়াই এত জোরদার।
উত্তরপ্রদেশের আখচাষিদের দুর্দশার কাহিনি যারা জানেন তারা এই কথার সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবেন। সেখানে চিনিকল মালিকরা চাষির আখ নিয়ে ইচ্ছামতো দাম দেয়, বা বছরের পর বছর দাম দেয় না। সরকার চিনিকল মালিকের হয়ে কাজ করে, অসহায় চাষির সর্বনাশ হয়। সে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে সর্বহারায় পরিণত হয়। এভাবেই সমস্ত চাষিকে কর্পোরেট হাঙরদের সামনে ফেলে দিয়ে মোদিজিরা কৃষক-কল্যাণের ভেলকি দেখাচ্ছে। কিন্তু কৃষকরা এই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছেন। তাঁরা বলছেন– ‘দয়া করে আমাদের উপকার করার চেষ্টা করবেন না। আমরা আপনাদের উপকার চাই না। বরং উপকার করার নামে যে আইন তৈরি করেছেন তার হাত থেকে আমাদের রেহাই দিন। আইন এখনই প্রত্যাহার করুন।’
মোদিজিরা যদি সত্যিই কৃষকের উপকার করতে চাইতেন, তা হলে তারা লাভজনক দাম দিয়ে কৃষকের ফসল সরকারি উদ্যোগে কেনার ব্যবস্থা করতেন, সার-বীজ তেল ইত্যাদি সস্তা দরে সরবরাহ করতেন, আর দেশের সাধারণ মানুষকে সস্তা দরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতেন। এতে কৃষক বাঁচত, সাধারণ মানুষ বাঁচত। কিন্তু এই পথে যাওয়ার ক্ষমতা মোদিজিদের নেই। কারণ, এতে জনগণের লাভ, কিন্তু কর্পোরেটের ক্ষতি। আর কর্পোরেটের ক্ষতি করার ক্ষমতা মোদিজিদের নেই। কারণ কর্পোরেট প্রভুদের দয়াতেই তো মোদিজিরা ক্ষমতায় বসেছেন। তাই ওদের বিরোধিতা করতে গেলে ওরা মোদিজিদের ক্ষমতা থেকে বের করে দেবে না? কৃষকরা আজ এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, কাদের স্বার্থে মোদিজিরা কাজ করছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, মোদিজিদের সত্যকার প্রভু কারা। তাই আন্দোলনের মধ্যে শুধু মোদিবিরোধী নয়, কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধেও আওয়াজ উঠছে এবং সেই আওয়াজ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। আওয়াজ উঠছে– আম্বানি-আদানি গো ব্যাক। আওয়াজ উঠছে, জিও বয়কট কর, আম্বানি-আদানিদের পণ্য বয়কট কর। দেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসে এই উপলব্ধি সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা।
আগেকার সমস্ত গণআন্দোলন ছিল সরকার বিরোধী। সরকারের পিছনে যে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি আছে, তাদের স্বার্থ রক্ষা করাই যে সরকারের কাজ, আন্দোলনের মধ্যে এই শ্রেণি চেতনার জন্ম দেওয়া যায়নি। ব্যাপক সংখ্যক জনগণ এই সত্যোপলব্ধি করতে পারেননি। এই কৃষক আন্দোলন এক উন্নত চেতনার জন্ম দিতে পেরেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বুঝতে পারছেন আসল শত্রু পুঁজিবাদ। বর্তমান কৃষক আন্দোলনের এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।
এই আন্দোলন নিপীড়িত মানুষের এক মহামিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই আন্দোলন শিখদের আন্দোলন নয়, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধদের আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত নিপীড়িত মানুষের। আন্দোলনের রণক্ষেত্রে সবধর্মের মানুষ এক লঙ্গরখানায় দাঁড়িয়ে আহার করছেন, এক সাথেই ধর্মাচরণ করছেন, আবার এক সাথে কাধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করছেন। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে, বিভেদের রাজনীতিকে পরাজিত করেছে এই আন্দোলন। সংগ্রামরত কৃষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করার কম চেষ্টা করেনি। তাদের সেই অশুভ চেষ্টা পরাজিত হয়েছে কৃষকদের সংগ্রামী চেতনার কাছে। এটাও আন্দোলনের সাফল্য।
আন্দোলন মানুষকে পাল্টে দেয়। বিজেপি সরকার জল বন্টন নিয়ে পাঞ্জাব-হরিয়ানার পুরনো বিবাদকে ব্যবহার করার শত চেষ্টা করেও সফল হয়নি। ‘পাঞ্জাবকে জল দিতে হবে’– এই দাবি তুলে হরিয়ানায় বিজেপি ধরনায় বসে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে হরিয়ানাকে খেপিয়ে তোলা। হরিয়ানার জনগণের চাপে সেই ধরনা তাদের তুলে নিতে হয়েছে। হরিয়ানার সাধারণ মানুষের কথা ছিল একটাই। তোমাদের হাত থেকে তো আগে কৃষি আর জমি বাঁচাই, তারপর জলের কথা ভাবব। জনগণের প্রতিরোধে বিজেপি নেতারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জনগণের এমন অসীম সাহসী প্রতিরোধের সামনে পড়তে হবে, এ কথা বিজেপি নেতারা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল করোনা মহামারির সুযোগ নিয়ে যেভাবে ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, বিমানবন্দর ইত্যাদি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে, একই ভাবে ওরা কৃষক ও সাধারণ মানুষের ঘাড়ের উপর এই কালা আইন চাপিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু কে জানত এমন অসম্ভব সম্ভব হবে। যারা সাত চড়েও রা কাটে না, সেই কৃষকরা যে এমন ভাবে বিদ্রোহ করবে, এমনভাবে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে যাবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল?
এই সংগ্রাম কৃষকের বিক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ নয়। এই সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ আই কে কে এম এস যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। যেদিন সরকার লোকসভায় বিলকে আইনে পরিণত করল, সেই ৫ সেপ্টেম্বর থেকে এআইকেকেএমএস, এআইকেএসসিসি-র গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে তা প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ভারত বনধ সফল করার জন্য ভারতের হাজার হাজার গ্রামে প্রচার করেছে, পথ অবরোধ করেছে, কৃষক কমিটি গঠন করেছে, নানা ভাষায় লক্ষ লক্ষ প্রচারপত্র প্রকাশ করেছে, আইনের সর্বনাশা ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নানা উপায়ে প্রচার করেছে। এভাবেই আন্দোলনের জমি তৈরি করেছে। এর পর ১৪ অক্টোবর সারা ভারত প্রতিরোধ দিবস পালন ও ২৬ নভেম্বর ভারত বনধ কর্মসূচি সর্বাত্মক সফল করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এআইকেকেএমএস। সাথে সাথে সংযুক্ত কিষান মোর্চার দিল্লি চলো ডাককে সফল করার কাজেও এই সংগঠন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হরিয়ানায় যখন এই প্রস্তুতির কাজ চলছিল জোরকদমে তখন বিজেপি সরকার গ্রেফতার করল সংগঠনের হরিয়ানা রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়করনজিকে। তারপর গ্রেফতার করা হল সংগঠনের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সম্পাদক কমরেড অমরনাথকে। দিল্লি অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য যখন এআইকেকেএমএস মধ্যপ্রদেশের কর্মী-সমর্থকেরা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করলেন তখন তাদের উত্তরপ্রদেশ সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে ৬৮ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। সংগঠনের কর্মীদের অনমনীয় দৃঢ়তার ফলে শেষপর্যন্ত তাদের দিল্লি যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হয় উত্তরপ্রদেশ সরকার। এই ভাবে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তারা দিল্লি অভিযানে পাঞ্জাবের কৃষক ভাইদের সাথে সামিল হতে পেরেছে। এবং প্রথম দিন থেকেই এআইকেকেএমএস কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করছে।
এই সংগ্রামে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন চিকিৎসক বন্ধুরা, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এআইডিএসও, এআইডিওয়াইও, এআইএমএসএস, এআইইউটিইউসি-র অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবকরা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য শ্রমজীবী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ। এই ঐকান্তিক সাহায্য সংগ্রামে জয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এতে কোনও সন্দেহ নেই।
এই সংগ্রাম ঐতিহাসিক, প্রত্যয়দীপ্ত। ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এ অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আন্দোলনকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধু বীরত্ব যথেষ্ট নয়, তার প্রয়োজন নানা কৌশলী পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন থাকা। বিজেপি সরকার জানে, কৃষকরা আইনের কোনও সংশোধনী চাইছেন না, চাইছেন কৃষক বিরোধী তিনটি আইন ও বিদ্যুৎ বিল-২০২০-র সম্পূর্ণ প্রত্যাহার। এই প্রশ্নে তারা অবিচল। কথার মায়াজাল বিস্তার করে, আলোচনার নামে যাতে সরকার কৃষকদের ঘাড়ে অন্য কিছু চাপিয়ে দিতে না পারে সে বিষয়ে সদাসতর্ক থাকা প্রয়োজন। এই আন্দোলনের পরিধি ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। আরও বেশি বেশি মানুষ এই সংগ্রামের সাথে পূর্ণ আবেগে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁরা এলাকায় এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলছেন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নাম লেখাচ্ছেন। গ্রামে গ্রামে তারা আওয়াজ তুলছেন, ‘লড়েঙ্গে, জিতেঙ্গে’। লড়ব, জিতব। এই সংগ্রামকে পরাজিত করবে সাধ্য কার!