আমরা তখনই বলেছিলাম এটা দেশের মানুষের সাথে বিরাট একটা প্রতারণা৷ এবার তা হাতেনাতে ধরা পড়ল৷ বিদেশ থেকে সব কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি হোক কিংবা নোট বাতিলের মধ্য দিয়ে কালো টাকাকে চিরতরে খতম করার ঘোষণাই হোক, সবই যে আদতে দেশের মানুষের সাথে বিরাট প্রতারণা তা প্রমাণ হয়ে গেল সুইস ব্যাঙ্কের দেওয়া সাম্প্রতিক তথ্যে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে সেখানে ভারতীয়দের জমা টাকার পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়ে ৭ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে৷ এই বৃদ্ধি ঘটেছে ২০১৬–র ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের পর৷ অর্থাৎ নোট বাতিলের পরও শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, ড্রাগ ব্যবসায়ী, অস্ত্রের চোরাকারবারি, আমলা, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক, সেলিব্রিটিরা অবাধে কালো টাকা পাচার করেছেন বিদেশে৷ তা হলে নোট বাতিল করে দেশের সাধারণ মানুষের এত দুর্ভোগ, এত মৃত্যু– তার কী প্রয়োজন ছিল? এর জবাব তো প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে৷ তিনি কী জবাব দিয়েছেন এর? আসলে ধরা পড়ে গিয়েছেন তিনি৷ তাই নীরবতাকেই ঢাল করেছেন তিনি৷ মাঠে নামিয়েছেন অন্য মন্ত্রীদের৷
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে কালো টাকা উদ্ধারকে প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু করে তুলেছিলেন৷ কাঠগড়ায় তুলেছিলেন কংগ্রেসকে৷ এ কথা ঠিক, দেশে এবং দেশের বাইরে কালো টাকার রমরমা কংগ্রেস রাজত্ব থেকেই৷ কিন্তু গত চার বছরে বিজেপি নেতারা কালো টাকার বিরুদ্ধে কী করলেন? তাঁরা ক্ষমতায় বসেই মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে ঘটা করে এ নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে ফেললেন৷ তারপর? কী বেরোল সেই তদন্তে? না, তদন্ত আর হয়নি৷ চেষ্টা হল এসব কিছুকে ভুলিয়ে দেওয়ার৷ কিন্তু বহু চেষ্টা করেও জনগণকে ভোলানো গেল না৷ এই অবস্থায় ২০১৬ সালে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিল ঘোষণা করলেন৷ বললেন, এবার কালো টাকার কারবারিরা একেবারে ঢিট হয়ে যাবে৷ ঢিট তো তারা হলই না বরং কালো টাকার পরিমাণ আরও পঞ্চাশ শতাংশ বেড়ে গেল৷ এখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের দিয়ে যুক্তি করাচ্ছেন, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থ যে কালো টাকা তা কে বলল?
প্রধানমন্ত্রীজি, ২০১৪ সালে আপনাদের কে বলেছিল যে সুইস ব্যাঙ্কের টাকাগুলি কালো? প্রধানমন্ত্রীর উচিত দেশবাসীর কাছে স্বীকার করা, কালো টাকা উদ্ধার করার সদিচ্ছা তাঁদের নেই৷ সুপ্রিম কোর্টের চাপে বিজেপি সরকার এক সময় বাধ্য হয়েছিল সুইস ব্যাঙ্কের কালো টাকার মালিকদের বেশ কিছু নাম মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টে জমা দিতে৷ কোর্ট তাদের সেই সব নাম প্রকাশ করতে বলেছিল৷ উত্তরে সরকার জানিয়েছিল এই সব নাম প্রকাশে অসুবিধা আছে৷ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তুর তা শুনে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন, মোদি সরকার কালো টাকার মালিকদের বাঁচাতে চাইছে কেন? মোদি সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে বিচারপতি বলেছিলেন, ‘সরকারের হাতে কালো টাকা উদ্ধারের বিষয়টা ছাড়তে পারছি না, তা হলে জীবদ্দশায় এর নিষ্পত্তি হবে না’৷
আজ যখন আবার সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল তখন ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়াল দেশের মানুষকে বোঝাচ্ছেন, জমা টাকার সবটাই যে কালো, তা ধরে নেওয়া হচ্ছে কেন? অরুণ জেটলি ব্লগে লিখেছেন, সুইস ব্যাঙ্কে জমা মানেই সেটা কর ফাঁকির টাকা নয়৷ বিজেপি মন্ত্রীদের এই সব যুক্তি থেকে বোঝা যায়, কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে এতদিন তাঁরা যে–সব প্রতিশ্রুতি দেশের মানুষকে দিয়ে এসেছেন তার পুরোটাই চালিয়াতি৷ আসলে তাঁরা কালো টাকার মালিকদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন৷ নানা কথার চাতুরিতে কালো টাকা উদ্ধারের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাচ্ছেন৷ সত্যিই কালো টাকা উদ্ধার তাঁদের উদ্দেশ্য হলে, সুইস ব্যাঙ্কে জমা টাকার এই বিপুল বৃদ্ধির সংবাদে তাঁরা উদ্বিগ্ন হতেন৷ তা কিন্তু তাঁরা হলেন না৷ পীযূষ গয়াল বললেন, খুব শিগগিরই সরকারের হাতে নাকি এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এসে যাবে৷ তারপর কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে কডা ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ গয়াল সাহেবরা তথ্য পাচ্ছেন না বলেই ব্যবস্থা নিতে পারছেন না এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? দেশে কালো টাকা যে একটা সমান্তরাল অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে তা কি সরকারের অজানা? তাই যদি হয় তা হলে দরকার কি তাঁদের সরকারে থাকার?
বিজেপি সরকার যে কালো টাকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না, সে কথাটাই আজ পরিষ্কার করে বোঝা দরকার৷ ভারতের সংসদীয় দলগুলি, সরকার, প্রশাসন প্রভৃতি মিলে একটা দুষ্ট চক্র কালো টাকার উপর শুধু নির্ভরশীল নয়, প্রতি মুহূর্তে তারাই বিশাল পরিমাণ কালো টাকার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, কালো টাকাই এই দলগুলির প্রাণভোমরা৷ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি নেতারা কালো টাকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না৷ পুঁজিপতিদের দেওয়া কালো টাকাতেই তাঁদের দল চলে, নেতারা চাটার্ড বিমানে চড়েন, নির্বাচনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেন, এমএলএ–এমপি কেনেন, সরকার ভাঙেন, গড়েন৷ এত সব তো জনগণের থেকে চাঁদা তুলে হয় না৷ তাই কালো টাকা ধরা দূরের কথা, নোট বাতিলের মতো সিদ্ধান্তের আড়ালে এই সব কালো টাকার কারবারিদের তারা সুযোগ করে দিয়েছে যাতে আরও বেশি বেশি টাকা তারা বিদেশে পাচার করতে পারে৷
বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের কাহিনি নেহাত প্রকাশ পেয়েছে তাই৷ যদিও এসব হিমশৈলের চূড়ামাত্র৷ পুঁজিপতি শ্রেণি আর তাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার বুর্জোয়া দলগুলির এই বোঝাপড়াই তো আজকের সংকটগ্রস্ত মরণাপন্ন পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য৷ শুধু পুঁজিপতিরা নয়, নীতিহীন রাজনীতিক এবং তাঁদের দলগুলিও আজ বিপুল অর্থের মালিক৷ নোট বাতিলের পর গুজরাটের সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে, যেগুলির অধিকাংশের ডিরেক্টর বিজেপি নেতারা, একটির তো স্বয়ং অমিত শাহ, সেগুলিতেই সবচেয়ে বেশি বাতিল টাকা বেআইনি ভাবে জমা করা হয়েছে৷ তা হলে কালো টাকার বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন কী করে? জেনেশুনে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারার মতো বোকা তো নন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, অরুণ জেটলিরা আবার, যেহেতু কালো টাকা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ রয়েছে, সেই ক্ষোভ যাতে তাঁদের বিরুদ্ধে না যায়, তাই মাঝে মাঝেই হুমকি দিতে হয়, বলতে হয়, তথ্য পেলেই আর কাউকে ছাড়া হবে না৷ এই জিনিসই তাঁরা গত চার বছর ধরে করে আসছেন৷
(৭০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ৬ জুলাই, ২০১৮)