উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে যুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ অথচ দুই দেশের মানুষই মনেপ্রাণে এই লড়াইয়ের বিরোধী৷ উল্টে তারা চায় দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসে থেকে বছরের পর বছর ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ–হুঙ্কার দিয়ে চলেছে তার দ্রুত অবসান হোক, এক হয়ে যাক দুটি দেশ৷ সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যম যতই দুই কোরিয়ার মধ্যেকার বিষাক্ত সম্পর্কের কথা ঢাক পিটিয়ে প্রচার করুক, তা যে ডাহা মিথ্যা– সম্প্রতি শীতকালীন অলিম্পিককে কেন্দ্র করে আবার তা প্রমাণিত হল৷
দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়ংচ্যাংয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে শীতকালীন অলিম্পিক৷ এতে যোগ দিতে উত্তর কোরিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া৷ তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়ে উত্তর কোরিয়া প্রতিনিধি পাঠিয়েছে সে দেশে৷ শুধু খেলাধূলায় যোগ দেওয়াই নয়, দুই দেশের সহমতের ভিত্তিতে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া একসঙ্গে মার্চ করেছে ঐক্যবদ্ধ কোরিয়ার নীল–সাদা পতাকা হাতে নিয়ে৷ দুই দেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি ঐক্যবদ্ধ মহিলা হকি টিম অংশ নিয়েছে অলিম্পিকে৷ দক্ষিণ কোরিয়ায় উপস্থিত হয়েছে উত্তর কোরিয়ার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল৷ দক্ষিণের প্রশাসন সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছে তাঁদের৷ উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিদেরও প্রবল উৎসাহে অভিনন্দন জানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার দর্শক সাধারণ মানুষ৷ শুধু খুশি হতে পারেননি সেখানে উপস্থিত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স৷ চারিদিকে উৎফুল্ল জনতার বিপুল উচ্ছ্বাসের মাঝে গোমড়ামুখে নিজের আসনে বসেছিলেন তিনি, এমনকী দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময়েও উঠে দাঁড়াননি৷
তাঁর অসন্তুষ্টি স্বাভাবিক৷ ৭৩ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সে দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে যে, ‘ভয়ঙ্কর’ উত্তর কোরিয়ার হাত থেকে দক্ষিণকে রক্ষা করার জন্যই নাকি তারা ও দেশে রয়েছে৷ অলিম্পিকের ময়দানে উত্তর কোরিয়ার প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের উষ্ণ আবেগ প্রমাণ করে দিল এই সাম্রাজ্যবাদী মিথ্যাচার তাঁরা একদমই পছন্দ করেন না৷
একসময় কোরিয়া ছিল জাপানি সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত লালফৌজের হাতে জার্মানি–ইটালি–জাপানের ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তি পরাজিত হলে জাপান কোরিয়া থেকে সরে যায়৷ সেই সময়ে কোরিয়াকে রক্ষা করার অজুহাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন মার্কিন সেনাবাহিনী কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশ দখল করে নেয় এবং যুদ্ধের শেষে গোটা কোরিয়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে– কায়রোর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের এই সিদ্ধান্তকে দু’পায়ে মাড়িয়ে ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজেদের তাঁবেদার সরকার বসিয়ে দেয়৷ এরপর ১৯৫০ সালে শুরু হয় কুখ্যাত ‘কোরিয়ান ওয়ার’৷ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উত্তর কোরিয়ার উপর লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলে, মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে৷ যুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৫৩ সালে৷ কিন্তু আজও পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কোনও শান্তিচুক্তি করেনি এবং খাতায়–কলমে যুদ্ধ–পরিস্থিতি বজায় রেখে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর উপর নিজের আধিপত্য কায়েম রেখেছে এবং সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি সেই দেশ সম্পর্কে অনর্গল মিথ্যা প্রচার করে চলেছে৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিজস্ব অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়া৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ব্ল্যাকমেলিংয়ের বিরুদ্ধে ছোট্ট দেশটির চ্যালেঞ্জ জানানোয় শক্তি পেয়েছে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষ৷ দক্ষিণ কোরিয়াতেও মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে৷ প্রমাদ গুণছে মার্কিন দস্যুরা৷ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে তাদের সরে যেতে হলে এশিয়ার উপর তাদের থাবা আলগা হয়ে যাবে৷ তাই উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে এহেন বিষোদগার৷
অথচ সাধারণ মানুষ বরাবরই দুই দেশের ঐক্যের পক্ষে৷ জনগণের চাহিদা উপলব্ধি করে দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে–ইন ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে দুই দেশের এক হওয়ার কাজে অগ্রণী হবেন৷ এতে ভ্রূ কুঁচকেছে মার্কিন প্রশাসনের কর্তাদের৷ কিন্তু সেই রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে উত্তর কোরিয়াকে শীতকালীন অলিম্পিকে আমন্ত্রণ জানাবার সাহস দেখাতে পেরেছেন প্রেসিডেন্ট মুন৷ কারণ এই কাজে তাঁর সঙ্গে রয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন৷ গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ অভিনন্দন জানালেও দুই কোরিয়ার সৌহার্দ্যের এই পরিবেশ সহ্য হচ্ছে না যুদ্ধ–ব্যবসায়ী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের৷ তাদের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যমগুলিতে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিকৃষ্ট মিথ্যা প্রচারের বন্যা বইছে৷