আমেরিকা এবং উত্তর কোরিয়ার বাগযুদ্ধ নিয়ে সংবাদমাধ্যম মাঝে মাঝেই গরম গরম খবর পরিবেশন করে চলেছে৷ কিছুদিন আগেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়াকে যে ধ্বংসের আগুনে পোড়ানো হবে, তা সারা দুনিয়ায় আগে কেউ দেখেনি৷ উত্তর কোরিয়ার থেকে তাঁর পরমাণু বোমার বোতামটা যে বড় তাও হুমকির সুরে বলেছিলেন ট্রাম্প৷ এদিকে যে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘন ঘন উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন, শীতকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে সেই দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওলে তাদের ক্রীড়াবিদরা উত্তর কোরিয়ার ক্রীড়াবিদদের সাথে একযোগে কুচকাওয়াজ করছেন দেখে ট্রাম্প সাহেব মার্কিন রণতরী এবং বিমান বহর পাঠিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার সীমানার খুব কাছাকাছি মহড়া দিতে৷ তাঁর আক্ষেপ, আমেরিকা–দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে ফাটল ধরাতে অলিম্পিকে গেছে উত্তর কোরিয়া৷ আবার হঠাৎ করে ১১ জানুয়ারি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নরম সুরে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম জং উনের সাথে তাঁর ভাল সম্পর্কের কথা জানিয়েছেন৷ আমেরিকার তুলনায় অতি ক্ষুদ্র মাপের একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মার্কিন কর্তাদের কতটা আতঙ্কিত করতে পারে এ সব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷
এর আগে আমেরিকার রচিত প্রস্তাব অনুযায়ী গত ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ক্ষুদ্র সমাজতান্ত্রিক দেশ উত্তর কোরিয়ার উপর নতুন করে কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বোঝা চেপেছে৷ সারা পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষকে ব্যথিত করে এক সময়কার সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন এবং রাশিয়াও এই মার্কিন খসড়াকে সমর্থন করেছে৷ গত সেপ্টে ম্বর মাসেও মার্কিন প্রস্তাব অনুসারেই রাষ্ট্রসংঘ একপ্রস্থ নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়ার উপর চাপিয়ে দিয়েছিল৷ শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে ক্যান্সার রোগীদের প্রয়োজনীয় কেমোথেরাপির ওষুধ পর্যন্ত ছিল তার আওতায়৷ এবারের নিষেধাজ্ঞায় উত্তর কোরিয়াতে পেট্রোলিয়ামের সরবরাহ ৯০ শতাংশ ছাঁটাই করার নিদান দেওয়া হয়েছে৷ বিদেশে কর্মরত উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১ লক্ষ নাগরিককে নিজের দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ রাষ্ট্রসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনেয়াকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদসংস্থা এএফপি জানিয়েছে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে অস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব না পড়লেও কৃষি যন্ত্রপাতি চালানো ও পরিবহণের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ায় খাদ্যাভাবের আশঙ্কা আছে৷ নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তরে কর্মরত ‘গ্লোবাল রিসার্চে’র প্রতিনিধি কারলা স্টিয়া লিখেছেন, আমেরিকার থেকে বহুগুণ বেশি শীত পড়ে উত্তর কোরিয়ায়৷ পেট্রোলিয়ামের সরবরাহ ৯০ শতাংশ কমে যাওয়া মানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়া, জ্বালানিতে ঘাটতি পড়া, ফলে বহু মানুষকে শীতে জমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার পথ নিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ৷ বাস্তবে এটা উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া অঘোষিত যুদ্ধ৷ যে রাষ্ট্রপুঞ্জের কথা ছিল দুনিয়ার শান্তিরক্ষার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করা, তারা দীর্ঘকাল ধরেই বাস্তবে মার্কিন শাসকদের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে৷
মার্কিন প্রচারযন্ত্র এবং তাদের সহযোগী হিসাবে সারা পৃথিবীর কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম একযোগে সমাজতান্ত্রিক এই ছোট্ট দেশটিকে ধ্বংস করার অজুহাত তৈরি করতে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে৷ উত্তর কোরিয়ার পরপর কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র এবং আইসিবিএম বা আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে বিশ্বশান্তির পক্ষে বিপদ আখ্যা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি মার্কিন শাসকরা ক্ষিপ্ত হয়ে নানা হুমকি দিয়ে চলেছে৷ বোঝাই যায় উত্তর কোরিয়ার শক্তিশালী পরমাণু অস্ত্রসম্ভারের অধিকারী হওয়ার ঘটনাকে আমেরিকা পরমাণু অস্ত্রে তার একচ্ছত্র আধিপত্যে হস্তক্ষেপ বলে মনে করছে৷ বিশ্বকে দাবিয়ে রেখে শোষণ করার বিরুদ্ধে এটা একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে আমেরিকা দেখছে৷ তাই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়েছেন উত্তর কোরিয়াকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হবে৷ কিন্তু বিশ্বশান্তির পক্ষে বিপজ্জনক কোন দেশ– উত্তর কোরিয়া না আমেরিকা এবং তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী শিবির?
নিরাপত্তা পরিষদের যে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাপাতে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছে তারা সকলেই লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে চলেছে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের জন্য৷ ২০১৭ সালেই রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশনে পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তির (এনপিটি) ৬ নম্বর ধারায় পরমাণু অস্ত্র রোধ বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে আমেরিকা, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশগুলি৷ এনপিটি–র ১ এবং ২ নম্বর ধারাকে অগ্রাহ্য করে আমেরিকা তার যুদ্ধজোট ন্যাটোর সাহায্যে সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরমাণু অস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করেছে৷ গত ৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে নতুন ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংক্রান্ত গবেষণা ও তার উৎপাদন বন্ধের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় উত্তর কোরিয়া, কিন্তু আমেরিকা তার বিরোধিতা করে৷ নিরস্ত্রীকরণ ও অস্ত্র প্রসার রোধে বহুপাক্ষিক উদ্যোগের বিরোধিতা করে ভোট দেয় আমেরিকা, কিন্তু এই উদ্যোগের পক্ষে দাঁড়ায় উত্তর কোরিয়া৷ তাহলে শান্তির পক্ষে কারা, আর কারা বিরুদ্ধে?
উত্তর কোরিয়াকে শায়েস্তা করার নামে মার্কিন শাসকরা কোরীয় উপদ্বীপে ৩০ হাজার এবং জাপানে ৫০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে৷ বিপুল পরিমাণ মারাত্মক অস্ত্রসম্ভার, রণতরীর বহর, পরমাণু অস্ত্রবাহী বিমান বহর, অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকা এই এলাকায় জড়ো করেছে৷ পরমাণু অস্ত্রবাহী বিশাল মার্কিন নৌবহর চীন সাগর ও কোরীয় উপদ্বীপের খুব কাছে নিয়ম করে টহল দিচ্ছে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পেন্টাগন কর্তারা উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদিন যুদ্ধ–হুমকি দিয়ে চলেছেন৷ সমস্ত বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম উত্তর কোরিয়াকে যুদ্ধবাজ, অবাধ্য দেশ হিসাবে প্রচার করছে৷ তাদের নেতাদের উন্মাদ হিসাবে তুলে ধরে তাদের চরিত্র হনন করা চলছে৷ সারা বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী মানুষ একসময় সমাজতান্ত্রিক চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে যে সক্রিয় সমর্থন পেতেন আজকের সাম্রাজ্যবাদী এই দুই দেশের কাছ থেকে তা পাওয়া সম্ভব নয়৷ শুধু তাই নয়, উত্তর কোরিয়ার উপরে মার্কিন পরিকল্পিত নিষেধাজ্ঞার সামনে এই দুই দেশ কার্যত আত্মসমর্পণ করেছে৷ এই পরিস্থিতিতে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে উত্তর কোরিয়ার আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র তৈরির অধিকার কি অস্বীকার করা যায়?
গণতন্ত্র রক্ষার স্বঘোষিত অভিভাবক সেজে নানা দেশের উপর সামরিক হামলা, বশ্যতা স্বীকার করতে না চাওয়া নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের অপহরণ এমনকী গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে হত্যা, রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরোধিতা করলেই শত্রু দেশ হিসাবে ঘোষণা করে সামরিক–অর্থনৈতিক আক্রমণ, মিথ্যা অজুহাতে ইরাকের মতো উন্নত দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে কে? খনিজ তেল এবং সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার উপর দখল কায়েম করতে আল কায়দা–আইসিস–এর মতো মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলিকে মদত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধ–পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে কোন দেশ– আমেরিকা না উত্তর কোরিয়া? লিবিয়া, সিরিয়ায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে উচ্ছেদ করতে আইসিস মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের হাতে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র এমনকী রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দিয়েছে কে? কার নীতির জন্য আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছেন– উত্তর কোরিয়া না আমেরিকা? এশিয়া–আফ্রিকা–ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের জন্য পরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক সংকট সৃষ্টি করছে কোন দেশ? ভিয়েতনামে বছরের পর বছর ধরে বোমাবর্ষণ, রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে মাইলের পর মাইল জমি ধ্বংস, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে কোন দেশ? একমাত্র কোন দেশটি পরমাণু বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এক নিমেষে হত্যা করেছে? এর কোনওটির উত্তরেই উত্তর কোরিয়ার নাম আসবে না৷ পরদেশ আক্রমণ করা দূরে থাক, কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কি কখনও উত্তর কোরিয়া নাক গলিয়েছে? ইতিহাস বলে – না৷ বিশ্বের মানুষ জানে বিশ্বজুড়ে ধ্বংস চালিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ এমন যুদ্ধবাজরা হঠাৎ যখন ঘোর যুদ্ধ–বিরোধী ভাব দেখায় তার মতলব বুঝতে অসুবিধা হয় কি?
অবিভক্ত কোরিয়াকে বিভক্ত করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের সীমান্তবর্তী কোরিয়া দীর্ঘসময় ধরে জাপানের উপনিবেশ ছিল৷ ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত লালফৌজের হাতে জার্মানি–ইতালি–জাপানের ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তি সম্পূর্ণ চূর্ণ হওয়ার পর জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং তারা কোরিয়া থেকে হটে যায়৷ কোরিয়ার জনগণ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সমাজতন্ত্রকে সাগ্রহে গ্রহণ করার স্বপ্নে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে৷ ১৯৩০–এর দশক থেকে কোরিয়ার কমিউনিস্টরা চীনের কমিউনিস্টদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন৷ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি অফ কোরিয়ার নেতা কিম ইল সুঙকে মুক্তি সংগ্রামের নেতা হিসাবে সমগ্র কোরিয়ার জনগণ গ্রহণ করেন৷ সারা দুনিয়াতেই সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখে আতঙ্কিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বোঝে অবিভক্ত সমাজতান্ত্রিক কোরিয়া গঠিত হলে কেবলমাত্র উত্তর–পূর্ব এশিয়া নয় সমগ্র এশিয়াতেই তাদের নাক গলানোর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে৷ তাই ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের দক্ষিণে জাপানি সেনাদের নিরস্ত্র করার অছিলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় উপস্থিত তাদের বিশাল বাহিনীর সাহায্যে কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশ তারা দখল করে৷ যদিও ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে কায়রো সম্মেলনের ঘোষণা ছিল যুদ্ধের শেষে সমগ্র কোরিয়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে একতরফাভাবে উত্তর ও দক্ষিণ দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি কাল্পনিক সীমারেখার কথা বলতে থাকে৷ ১৯৪৮ সালের মে মাসে মার্কিন তাঁবেদার সিংম্যান রি–কে প্রধান করে দক্ষিণ কোরিয়ায় আলাদা সরকার গঠন করে মার্কিন দখলদাররা৷ ওই বছরই সেপ্টেম্বরে কোরিয়ার বাকি অংশের জনগণ সমাজতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া গঠন করেন৷ রাষ্ট্রপতি হন কোরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের নেতা কিম ইল সুঙ৷ মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গায়ের জোরে দেশকে দু’টুকরো করা হল শুধু তাই নয়, কোরিয়ার মানুষ কোন সমাজব্যবস্থা চায় তা বেছে নেওয়ার মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷
সেই সময় চীনের বুকে মহান মাও সে–তুঙের নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বিজয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে৷ সেই বিপ্লবকে রুখতে এবং সোভিয়েত রাশিয়া ও সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করতে প্রথম থেকেই দক্ষিণ কোরিয়াকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে আমেরিকা পুরোদস্তুর যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে৷ ১৯৪৯ সালের আগস্ট এবং অক্টোবরে তারা চীনের উপর ব্যাপক বোমবর্ষণ করে, সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনকে আক্রমণ করতে কুখ্যাত সপ্তম নৌবহরকে তাইওয়ান প্রণালীতে পাঠায়৷ দুই কোরিয়ার মানুষের মধ্যে এক হওয়ার আকাঙক্ষাকে বাধা দিতে ১৯৫০–এর ২৫ জুন রাষ্ট্রসংঘকে রাবারস্ট্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা উত্তর কোরিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ ১৯৫০–এর জুন থেকে ১৯৫৩–র জুলাই মাসের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার উপরে ৬ লক্ষ ৩৫ হাজার টন বোমা ফেলা হয়৷ যার মধ্যে ৩২ হাজার ৫৫৭ টন ছিল বিধ্বংসী নাপাম বোমা৷ এই যুদ্ধে আমেরিকা ব্যাক্টেরিয়ার সাহায্যে জীবাণুযুদ্ধ, মারাত্মক রাসায়নিক ইত্যাদি নিষিদ্ধ অস্ত্র নির্বিচারে ব্যবহার করলেও রাষ্ট্রসংঘ এর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করেনি৷ গোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যত বোমা পড়েছিল তার থেকে অনেক বেশি বোমা আমেরিকা এই তিন বছরে উত্তর কোরিয়ার উপর বর্ষণ করে৷ এই বর্বর আক্রমণে উত্তর কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি মানুষ নিহত অথবা মারাত্মক আহত হন৷ সে সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া এবং সদ্য সমাজতন্ত্রে উন্নীত চীন যথাসাধ্য সাহায্য নিয়ে উত্তর কোরিয়ার মানুষের পাশে দাঁড়ায়৷ রাষ্ট্রসংঘের বকলমে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির পুরো শক্তি এই যুদ্ধে নিযুক্ত হলেও সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য উত্তর কোরিয়ার জনগণের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং বিশ্বজুড়ে শান্তিকামী মানুষের প্রতিবাদের সামনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা পিছু হটে৷ কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তিতে আমেরিকা বাধা দেয়৷
সমাজতন্ত্র অবলম্বন করে উন্নত জীবন পেয়েছে উত্তর কোরিয়া
রাষ্ট্রসংঘের বকলমে মার্কিন প্রচারবিদরা বলে চলেছেন উত্তর কোরিয়ার মানুষ প্রায় না খেয়ে আছে৷ তারা দেশ ছেড়ে পালাতে চায়, উত্তর কোরিয়ায় নাকি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে৷ শিশুরা অত্যাচারিত হচ্ছে৷ দেশের মানুষকে জোর করে পূর্বতন শাসকদের মূর্তির সামনে মাথা নত করানো হয় ইত্যাদি– যা সর্বৈব মিথ্যা৷ চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক শিবির ভেঙে যাওয়ার পর সারা দুনিয়ার মতোই উত্তর কোরিয়ার উপরেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এই ছোট্ট দেশটির সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে বারবার যে ধরনের আর্থিক অবরোধ সাম্রাজ্যবাদীরা চপিয়ে দিয়েছে, তার ফলে সে দেশের মানুষের জীবন অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হয়েছে৷ এর মধ্যেও উত্তর কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বর্ণোজ্জ্বল জীবনযাত্রার কথা তুলে ধরেছেন কানাডা এবং আমেরিকার যৌথ নাগরিক সাংবাদিক ইভা বারলেট৷ তিনি লিখেছেন, আর যাই হোক উত্তর কোরিয়ায় কোনও ডাক্তার– নার্সের ঘাটতি নেই৷ চিকিৎসা সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে মেলে৷ আর্থিক অবরোধের ফলে সিটি–স্ক্যান বা এমআরআইয়ের মতো উন্নত যন্ত্রপাতি কিনতে অসুবিধা হলেও তারা দমে যায়নি৷ শিক্ষাও সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং যথেষ্ট উন্নত৷ তিনি দেখেছেন রাজধানী পিয়ংইয়ং সহ সমস্ত শহরগুলিতে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশু এবং আনন্দে উচ্ছল মানুষের ভিড়৷ তিনি মার্কিন প্রচারকে বলেছেন, বাস্তবের বিকৃতি, যা ইচ্ছাকৃত অপরাধ৷ (মিন্ট প্রেস, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭)৷
দুই কোরিয়ার মানুষই মার্কিন জবরদস্তির বিরুদ্ধে
মার্কিন লগ্নি, মার্কিন কর্পোরেটের সাথে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের বিপুল সম্পদ লাভ হলেও সে দেশের বেশিরভাগ মানুষ সাম্রাজ্যবাদী জবরদস্তি এবং শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার৷ দেশের মানুষের চাহিদাকে ফেলতে না পেরে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়াকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টও এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দীর্ঘকাল বন্ধ থাকা হটলাইন টেলিফোন চালু করে দিয়েছেন৷ কিছুদিন আগে হওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে–ইন উত্তর কোরিয়ার সাথে এক হওয়ার জন্য আলোচনা চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বারবার৷ যদিও প্রেসিডেন্ট মুন যাতে আলোচনায় না বসেন তার জন্য মার্কিন কর্তারা হুমকিও দিয়ে রেখেছেন৷ এই ঘটনা প্রমাণ করে উত্তর কোরিয়ার মতোই দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মধ্যেও এক হওয়ার জন্য প্রবল আবেগ কাজ করছে৷ আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়াতে ‘থাড’ (টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স) ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বসাতে গেলে সে দেশের মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ দেখিয়েছে৷ বস্তুত বিগত ৬৪ বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার সমস্ত আলোচনা প্রস্তাবকে আমেরিকা অগ্রাহ্য করে চলেছে৷ যে আমেরিকা ১ হাজার ৫৪ বার পরমাণু বোমা পরীক্ষা করে গোটা দুনিয়াকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছে, তাদের মুখে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী বুলির প্রকৃত স্বরূপ দুনিয়ার গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের বুঝতে বাকি নেই৷
মার্কিন ব্ল্যাকমেলিংয়ে মাথা নত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না
ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী নেতৃত্বের সময় থেকেই মার্কিন নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেলিংয়ের সামনে সোভিয়েত রাশিয়া আপসকামী ভূমিকা নিয়ে চলায় এমনিতেই বিশ্বজুড়ে শান্তির শক্তির ক্ষতি হয়েছে৷ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে আপস করে চলে এই সর্বনাশকে রোখা যে যায় না তা পদে পদে প্রমাণ হয়ে গেছে৷ সাম্রাজ্যবাদই যে যুদ্ধের কারণ তাকে চাপা দিতে দীর্ঘকাল ধরে একদল প্রচার করত সমাজতান্ত্রিক শিবির আর সাম্রাজ্যবাদী শিবির এই দুই শিবিরের দ্বন্দ্বের ফলেই পৃথিবীতে যুদ্ধ–উত্তেজনা বাড়ছে৷ সমাজতান্ত্রিক শিবির সাম্রাজ্যবাদীদের দাবি মেনে নিলেই সব শান্তি৷ দেখা গেল ঠিক উল্টো৷ সমাজতান্ত্রিক শিবির ধ্বংসের পর তথাকথিত একমেরু বিশ্বেই ছোট–বড় যুদ্ধ প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ধ্বংসের সময় রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি গোরবাচভকে মার্কিন স্বরাষ্ট্রসচিব জেমস বেকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জার্মানির পর আর এক ইঞ্চিও ন্যাটো এগোবে না৷ আর আজ সারা রাশিয়া ন্যাটোর অস্ত্রভাণ্ডার দ্বারা পরিবেষ্টিত৷ উত্তর কোরিয়া নিয়ে মার্কিন কর্তাদের কিছু কিছু সুর নরমের ঘটনার কারণ সে দেশের অর্জিত শক্তি৷ উত্তর কোরিয়ার প্রধান শক্তি সে দেশের জনগণের ঐক্য৷ কিন্তু কোনও হুমকির সামনেই আত্মরক্ষার হাতিয়ার তারা ছাড়তে পারে না৷ মনে রাখা দরকার, ইরাকের হাতে পরমাণু অস্ত্র ছিল না, লিবিয়ার হাতে পরমাণু অস্ত্র ছিল না– কিন্তু তাদের ধ্বংস করার অজুহাত পেতে মার্কিন দস্যুদের অসুবিধা হয়নি৷ পরমাণু অস্ত্র সহ সমস্ত ধরনের মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরই সবসময় আওয়াজ তুলেছে৷ কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদল অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আর সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়ার অপরাধে উত্তর কোরিয়ার আত্মরক্ষার অধিকার থাকবে না এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না৷ উত্তর কোরিয়া বারবারই বলেছে তারা সমস্ত অস্ত্রই কেবলমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তৈরি করেছে৷ বিশ্বের মানুষের অভিজ্ঞতাও বলছে তাদের এই কথার কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি৷
আজ তাই সারা বিশ্বে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষও উত্তর কোরিয়ার জনগণের ন্যায্য অধিকারের পাশে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছেন– মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উত্তর কোরিয়া থেকে হাত ওঠাও৷