উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে আর একবার বিজেপির জয় জনমনে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। ভয়াবহ বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার শোচনীয় হাল, সরকারি ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, প্রশাসনের দলদাসত্ব, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, দলিত এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, বেওয়ারিশ গবাদি পশুর পালের জন্য কৃষকদের সমস্যা এই সমস্ত কিছু নিয়ে জনগণের ক্ষোভ বারবার ফেটে পড়ছে। বেকারত্বের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবরা রাজ্যে আন্দোলন করেছেন, তাতে লাঠি চলেছে। মোদি সরকারের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশের কৃষকদের মতোই উত্তরপ্রদেশের কৃষকরাও আেন্দোলনে নেমেছেন। জনমনে প্রশ্ন, নির্বাচনী ফলে তার প্রভাব কোথায়?
এই নির্বাচনের আগে থেকেই কিছু কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম প্রচার করছিল, বিজেপি উত্তরপ্রদেশে হারলে দেশে আর্থিক সংস্কারের রথ থমকে যাবে। এখন বিজেপি জেতার পরেই তারা জোর গলায় বলছে, এই জয়কে কাজে লাগিয়ে বিজেপি বাকি থাকা সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারি মালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা দ্রুত সেরে ফেলুক। বলা হচ্ছে ১৩ মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের পরেও যখন বিজেপি জিতল, তাতেই প্রমাণ কৃষকরা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি। কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের পেটোয়া বিশ্লেষকরা গম্ভীর মুখে রায় দিচ্ছেন, এই জয়কে কাজে লাগিয়ে এখনই সম্পূর্ণ একচেটিয়া পুঁজি নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থার লক্ষ্য আইন নতুন করে আনুক সরকার। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, এই নির্বাচনী ফলে প্রবল খুশি হয়েছে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি। শোষকরা যাতে খুশি হয়, শোষিতের তাতে খুশির কিছু থাকে কি?
নির্বাচনে জনজীবনের ইস্যুগুলি রইল অবহেলিত
উত্তরপ্রদেশে কর্মক্ষম মানুষের মাত্র ৩২.৭৯ শতাংশ কাজ করেন। শিক্ষার হারে দেশের শেষ পাঁচটি রাজ্যের অন্যতম হল উত্তরপ্রদেশ। রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইট অনুসারে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ নিরক্ষর, মহিলাদের ৪১ শতাংশ নিরক্ষরতার অন্ধকারে। রাজ্যের প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষই দরিদ্র। এই রাজ্যে মহিলাদের উপর অত্যাচার ২০১৫ সালের তুলনায় বেড়েছে ৬৬ শতাংশের বেশি। সরকারি খাতায় নথিভুক্ত নারী নির্যাতন-ধর্ষণ ইত্যাদি মিলিয়ে ২০১৯ সালে সে রাজ্যে ৫৯,৮৫৩ জন নারী (প্রতিদিন ১৬৩ জনের বেশি) নির্যাতনের শিকার।
করোনা মহামারীর সময় উত্তরপ্রদেশে মানুষের চরম দুর্দশা, বিনা চিকিৎসায় অসংখ্য মৃত্যু, গঙ্গায় ভেসে যাওয়া শত শত মানুষের মৃতদেহ সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষের জীবন রক্ষায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের চরম ঔদাসীন্য এবং অপদার্থতা দেখে সাধারণ মানুষ রাগে ফুঁসেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি এই রাজ্য সরকারের ক্ষমার অযোগ্য আচরণ ভুলে যাওয়ার নয়। অথচ নির্বাচনের সাতটি পর্বের প্রচারে জনজীবনের মূল সংকটগুলি নিয়ে চর্চা প্রায় হলই না!
বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র মানে পাঁচ বছর অন্তর একটা নির্বাচন। সেই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের যে কার্যত কোনও ভূমিকা নেই এবারের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ ১৯৭৪ সালে একটি রাজনৈতিক শিক্ষা শিবিরে বলেছিলেন, ‘‘ইলেকশন হচ্ছে একটি বুর্জোয়া পলিটি‘। জনগণের রাজনৈতিক চেতনা না থাকলে, শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম এবং এবং শ্রেণি সংগঠন না থাকলে, গণআন্দোলন না থাকলে, জনগণের সচেতন সংঘশক্তি না থাকলে শিল্পপতিরা, বড় বড় ব্যবসায়ীরা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা বিপুল টাকা ঢেলে এবং সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে যে হাওয়া তোলে, যে আবহাওয়া তৈরি করে, জনগণ উলুখাগড়ার মতো সেই দিকে ভেসে যায়।” সদ্য সমাপ্ত উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন সহ যে কোনও বুর্জোয়া সংসদীয় নির্বাচনকে খুঁটিয়ে দেখলে এই কথার প্রতিটি অক্ষর সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এখন বিজেপির পিছনে ভারতের একচেটিয়া পুজি মালিকরা সব থেকে বেশি টাকা ঢালছে। এছাড়াও আছে তাদের দেওয়া বিপুল পরিমাণ কালো টাকা। যা দিয়ে পেশিশক্তির কারবারি বাহুবলী মাফিয়া ও প্রশাসনকে কিনতে সুবিধা হয়। অসচেতন মানুষের মধ্যেও নানাভাবে প্রভাব তৈরিতে এই টাকা বড় ভূমিকা নেয়। প্রচারের জাঁকজমকে মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। সাথে যুক্ত হয়েছে পুঁজিপতিদের টাকায় চলা কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের বিজেপির পক্ষে কখনও গলা ফাটিয়ে প্রচার কখনও সূক্ষ্মভাবে ‘স্থায়ী সরকার’, ‘শক্তিশালী সরকার’, ‘শিল্পায়নের জন্য বেসরকারিকরণের প্রয়োজনীয়তা’, ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ ইত্যাদি নানা বিষয়ের আড়ালে বিজেপির পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা। একচেটিয়া পুঁজির চরম শোষণের স্বার্থে তাদের এজেন্ট বিজেপি সরকার যে কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতোই নির্বাচন কমিশনকেও দলগত এবং প্রশাসনিকভাবে কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশে ভোটে কারচুপির বহু অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, কমিশন কানও দেয়নি।
জাতপাত, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা প্রধান হয়ে উঠল
কৃষক আন্দোলনে ধাক্কা খাওয়ার পর বিজেপি বুঝেছিল, এইবার উত্তরপ্রদেশের ভোটে ভেলকি না দেখালে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তার বিপদ আছে। তাই সব কাজ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী কয়েকমাস ধরে উত্তরপ্রদেশেই প্রায় পড়ে থেকেছেন। কিন্তু মানুষের সমস্যা নিয়ে তিনি কী বললেন? তিনি গঙ্গায় নেমে ক্যামেরা সাক্ষী রেখে পুজো দিয়েছেন, সরাসরি হিন্দু ভোট সংহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। নানা কথার আড়ালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্বিচারে মাফিয়া, অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছেন, রামমন্দির নিয়ে কৃতিত্ব দাবি করেছেন, বারাণসীর ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে আবেগঘন বত্তৃতা দিয়েছেন। এগুলোই কি মানুষের সমস্যা ছিল? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাজ্যের গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রীও হিন্দুমানসে ভয় জাগিয়ে ভোট কুড়োতে মুসলিম ভোট একজোট হওয়ার মিথ্যে ধুয়া তুলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে হিন্দু বনাম মুসলমান হিসাবে দেখাতে তোতাপাখির মতো আওড়েছেন, লড়াইটা ৮০ বনাম ২০ শতাংশের। ২০১৭ সালে মুজফফরনগরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভর করে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটানা বিজেপি সরকার লাভ জেহাদ, ধর্মান্তর বিরোধী আইন, গো-রক্ষার অজুহাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর শারীরিক এবং অর্থনৈতিক আক্রমণ, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ভরা, সরকারি পয়সায় আন্দোলনকারীদের নামে কুৎসা প্রচারের হোর্ডিং টাঙিয়ে তাদের বিপদগ্রস্ত করার কাজই করে গেছে। যোগী আদিত্যনাথকে বিজেপি বলেছে, ‘বুলডোজার বাবা’। অর্থাৎ একদিকে তিনি মঠের সন্ন্যাসী, অন্য দিকে তিনি বলবান। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষের বস্তি, ঝুপড়ি ভেঙে দেওয়াকে বিশেষ কৃতিত্বের বলে তুলে ধরেছে তারা।
প্রচার তোলা হয়েছে যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্বে নাকি উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। অথচ বাস্তব হল, বিনা বিচারে এনকাউন্টার এবং পুলিশের ইচ্ছামতো হত্যাই এখন উত্তরপ্রদেশের আইন। পূর্বতন কংগ্রেস অথবা সপা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা স্থানীয় কিছু গুণ্ডাকে হটিয়ে জায়গা নিয়েছে বিজেপির মদতপুষ্ট বড় মাফিয়া, উচ্চবর্ণের বাহুবলীরা। হাথরসে, উন্নাওয়ের ঘটনাতেও দেখা গেছে এই সব মাফিয়া নেতারা চরম অন্যায় করেও ঘুরপথে সব ক্ষমতাই ভোগ করছে। উত্তরপ্রদেশে বিগত পাঁচ বছরে একের পর এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দেওয়া হয়েছে, সম্পাদকদের পুলিশ নানা অজুহাতে হেনস্থা করেছে। বিরোধী কণ্ঠস্বর মাত্রেই দেশের শত্রু, এই আওয়াজ তুলে বিজেপি সরকার যে কোনও বিরুদ্ধতাকে গলা টিপে মেরেছে। একদিকে সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের বিভাজন, ধর্মীয় অন্ধতার প্রসার, শিক্ষা ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটানো, মেয়েদের উপর ক্রমাগত হামলা ও তাদের বাঁচানোর অজুহাতে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বেঁধে ফেলা এই হল বিজেপির হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা।
অন্যদিকে ‘কড়া সরকারের’ ধুয়ো তুলে বিরোধীদের দুরমুশ করে বিজেপি-আরএসএস তাদের ফ্যাসিস্ট নীতির ল্যাবরেটরি হিসাবে উত্তরপ্রদেশকে ব্যবহার করছে। অন্যান্য রাজ্য সরকারের মতোই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার অভাবী মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে ভিক্ষাতুল্য কিছু অনুদান ছুঁড়ে দিয়েছে। একদল বিশ্লেষক বলছেন, কিছু পরিবারকে বিনাপয়সায় রেশন, কৃষকদের সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য, মুদ্রা যোজনায় মহিলাদের ঋণ, দরিদ্রদের জন্য বিদ্যুতে সামান্য ভর্তুকি ইত্যাদির জোরেই বিজেপি গদি ধরে রাখতে পেরেছে। এই প্রচারও দেখিয়ে দেয়, বিজেপি শাসনে সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়!
বিজেপি বিরোধী দলগুলির ভূমিকা কী? জাতীয় স্তরে বিজেপির প্রধান সংসদীয় বিরোধী কংগ্রেসের প্রধান দুই মুখ পুরো ভোট-প্রচারপর্বটায় ক্যামেরা সাক্ষী রেখে মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বিজেপির পাল্টা হিন্দুত্বের হাওয়া তোলার চেষ্টা করে গেছেন। সে রাজ্যে সরকারি গদির অন্যতম দাবিদার সমাজবাদী পার্টি ব্যস্ত থেকেছে যাদব সহ নানা জাতপাতের সমীকরণ কষে এবং সংখ্যালঘুদের ত্রাতা সেজে ভোট জেতার চেষ্টায়। জনজীবনের কোনও দাবিতে এদের কেউই কোনওদিন গণআন্দোলন করেনি। এমনকি ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে তারা টুইটারে বিবৃতির বাইরে কিছুই করেনি। তাদের লক্ষ্য জনগণের মধ্যে থাকা বিজেপি বিরোধী বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে আখের গুছানোর রাজনীতি করা। বিজেপি এবং তার বিরোধী সব দলই একই বুর্জোয়া ভোট-রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ। বিজেপি বিরোধী হিসবে এরা মূলত জাতপাত, নরম সাম্প্রদায়িকতার যে রাস্তা নিয়েছে তা বিজেপির থেকে বিশেষ আলাদা কিছু নয়। এর উপর সোসাল মিডিয়া থেকে মুখ তুলে এইসব বিরোধী নেতা-নেত্রীরা রাস্তায় নামতে যতদিনে উদ্যোগী হয়েছেন তার আগেই আরএসএস-এর শক্তি এবং কর্পোরেট পুঁজির দেওয়া বিপুল টাকার সাহায্যে বিজেপি তার ভোট মেশিনারি সাজিয়ে নিয়ে ঘরে ঘরে বিষ ছড়ানোর কাজটি করেছে। একই সাথে কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম চেষ্টা চালিয়েছে জনগণের প্রকৃত দাবিগুলিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বুর্জোয়া স্বার্থকেই সামনে আনার। এ জন্য তারা লড়াইটাকে মূলত বিজেপি আর সপা এই দুই দলের লড়াই হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে দিতে চেয়েছে। পাশাপাশি ডুবন্ত কংগ্রেসকে কিছুটা প্রচারের জোরে ভাসিয়ে রেখেছে। ফলে একচেটিয়া মালিকদের বর্তমানের সবচেয়ে পছন্দের দল বিজেপিই সুবিধার ফসলটা ঘরে তুলেছে এবং মালিকদের পরিকল্পনা মতোই আসাদুদ্দিন ওয়েইসির মিম মুসলিম ঐক্যের জিগির তুলে বিজেপির পক্ষে হিন্দু ঐক্যের জিগিরকে সাহায্য করেছে। সর্বত্রই তারা যেমন বিজেপির ত্রাতা হিসাবে অবতীর্ণ হয়, এক্ষেত্রেও তা হয়েছে। সিবিআইয়ের ভয়ে কাঁটা মায়াবতীর বিএসপিও একই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে বিজেপির জয়ে সাহায্য করেছে।
কৃষক আন্দোলনের গৌরব ম্লান হওয়ার নয়
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়ের পর বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম ১৩ মাস ধরে চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনকে ব্যর্থ বলে দেখাতে চাইছে। দেখাতে চাইছে, এই আন্দোলন গরিব কৃষকের ছিল না। যদিও বাস্তব হল, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের যে জায়গাগুলিতে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব ছিল সেই বাগপত, সামলি, মিরাট, মুজফফরনগর জেলার ১৯টির মধ্যে ১৩টি আসনে বিজেপি হেরেছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় কৃষক প্রধান সমস্ত এলাকায় বিজেপির ভোট শতাংশ অনেক কম। জনগণের ক্ষোভ এতটাই যে, বিজেপির উপমুখ্যমন্ত্রী এবং ১১ জন মন্ত্রী সহ ৮০ জন পুরনো এমএলএ হেরেছেন। ১৩১টি কেন্দ্রে ১ থেকে ৫ শতাংশের পার্থক্যে ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু কেন্দে্র পার্থক্য ২০০ থেকে ১০০০ ভোটের। বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম ভুলিয়ে দিতে চাইছে যে, কৃষক আন্দোলন ভোটের আখের গোছানোর আন্দোলন ছিল না। যদিও তারাও অস্বীকার করতে পারেনি এই আন্দোলন উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। যে কারণে সবচেয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভাষণ দেওয়া সঙ্গীত সোমের মতো বিজেপি নেতারা হেরেছেন। এই আন্দোলন যেভাবে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ঐক্যের সম্ভাবনা সূচিত করেছে, একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থেই যে সরকার চলে, তা বুঝতে জনগণকে সাহায্য করেছে, গণআন্দোলনের প্রতি মানুষের আস্থাও কিছুটা তৈরি হয়েছে, তাতে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ভীত। এ জন্যই কৃষক আন্দোলনের বিপক্ষে সুকৌশলে প্রচার চলছে। যদিও এ অপচেষ্টা সফল হবে না।
গণআন্দোলনই রাস্তা
উত্তরপ্রদেশে সীমিত শক্তি নিয়েও এসইউসিআই(সি) দল জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার ধারাবাহিক চেষ্টা করে চলেছে। সিপিআই, সিপিএমের মতো বামপন্থী দলগুলির কাছেও বারবার আবেদন জানানো হয়েছে ভোট রাজনীতির হিসাবের খাতা থেকে বেরিয়ে গণআন্দোলনের রাস্তায় নামতে। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটতে নারাজ। কৃষক আন্দোলনের সময়েও তারা ব্যস্ত থেকেছে কংগ্রেস, সপা, আরজেডি সহ নানা দলের সঙ্গে কোথায় কীভাবে গেলে ভোটে সুবিধা হবে এই হিসাব কষতে। কিন্তু বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে পরিসরটা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাকে ব্যবহার করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে তারা চায়নি। এসইউসিআই(সি)-র পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে বিজেপির রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে জাতপাত সহ নানা সাম্প্রদায়িক কৌশল নিয়ে চলা দলগুলির গায়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তকমা এঁটে দিয়ে জোড়াতালির ভোট-কৌশলের রাস্তা ধরলে চলবে না। বিজেপি-আরএসএসের সাহায্যে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নামিয়ে আনতে চাইছে তাকে রাজনৈতিক এবং আদর্শগত দিক থেকে পরাস্ত করতে গেলে সংগ্রামী বামপন্থার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের রাস্তা ধরতে হবে। এর মধ্য দিয়ে জনগণের শক্তি হিসাবে গণকমিটি গড়ে তোলা দরকার যাতে সচেতন জনগণ ঠিক-ভুল রাজনীতিকে বিচার করার শক্তি অর্জন করে।
উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে বামমনস্ক, গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন সমস্ত মানুষের গণআন্দোলনের রাস্তায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া আজ প্রয়োজন। এর বদলে বুর্জোয়া রাজনীতির নির্বাচনী ছকের মধ্য থেকেই আখের গোছাতে চাইবে যারা, তারা যে স্লোগানই দিক না কেন, শেষ পর্যন্ত একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষা এবং ফ্যাসিবাদ কায়েমেরই চেষ্টা করবে। বিকল্প রাজনীতি একটাই– তা হল গণআন্দোলন।